মিসেস ডসন স্কট পি. ই.এন. এর প্রতিষ্ঠাতা, তার এই অসম্ভব উদ্যোগের জন্য তাকে পেনের মা সম্বোধন করা হত। এখানে তারই জীবনের গল্প অল্প কথায় বলা হয়েছে।
পি.ই.এন. ইনটারনেশনাল বা ইন্টারনেশনাল পেন এর প্রাথমিক প্রতিষ্ঠাতা হলেন ক্যাথরীন অ্যামি ডসন স্কট, বিয়ের আগে তার নাম ছিল ক্যাথরীন অ্যামি ডসন। তারপর তাকে ডাকা হত মিসেস স্যাফো, পরে বলা হত মাদার অব পেন বা বাংলায় ‘পেনের মা’।
৩১শে আগস্ট ১৮৬৫ সালে ক্যাথরীন অ্যামি ডসন স্কট দক্ষিণ লন্ডনে, ডালউইচের গথিক লজে জন্মান।
১৯৩৪ সালের ৪ নভেম্বর লন্ডনে হাস্পাতালে মারা যান।
ক্যাথরীনের বাবা এবেনেযার ডসন ছিলেন একজন ইট প্রস্তুতকারক, তার মা ছিলেন স্কটিশ বংশোদ্ভুত ক্যাথ্রীন আর্মস্ট্রংগ।ক্যাথরীন ১৮ বয়সে উচ্চবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে তার নিজস্ব জীবিকা শুরু করেন। প্রফেসর জেনিংস বলে একজন অন্ধ বয়োজেষ্ঠ মানুষের সেক্রেটারী হন। প্রফেসর জেনিংসের জন্য অন্যান্য কাজ সহ কখনো উচ্চস্বরে কয়েক ঘন্টা ধরে বই পড়তে হত। জেনিংস তাকে পছন্দ করতেন কারন তার উচ্চারণ ছিল পরিষ্কার এবং মিস্টি। তিনি তাকে শুধু কিছু জ্ঞান লজিক ও গ্রীক ভাষা শেখান নি তাকে অন্যের উপর কথা বার্তায় চালচলনে সঠিক বিচার বিশ্লেষন করা- ‘স্কেপ্টিসিজম’ ও শেখান। তাকে তখনকার দিন অনূযায়ী ৪০০ পাউন্ড বছরে মাইনে দিতেন যেখানে একজন কেরাণী বছরে ১০০ পাউন্ড উপায় করত আর একজন প্রফেসর বছরে ৭০০ থেকে ১০০০ পাউন্ড উপায় করে। চার বছর পর প্রফেসর মারা গেলে ২২ বছরের ক্যাথরীন তার সকল সঞ্চয় নিয়ে লন্ডনে চলে এলেন। সেখানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। খবরের কাগজে তার কবিতা , ছোটগল্প ইত্যাদি প্রকাশ করে লেখার পেশা বা জীবিকা শুরু করেন।কস্টেমস্টে যা পেতেন তাই দিয়ে দিন কাটিয়ে দিতেন। তার যা সঞ্চয় ছিল তাতে হাত দিতেননা।
১৯৮৮ সালে ২৩ বছর বয়সী ক্যাথরীন সি এ ডসন নামে একটি বই প্রকাশ করেন ‘শ্যারাডজ ফর হোম অ্যাক্টিং’।
এক বছর পর তার নিজের টাকায় তার প্রথম সাহিত্য সৃস্টি ‘স্যাফো’ নামে ২১০ পাতার এক লম্বা মহাকাব্য প্রকাশ করেন, এতে গ্রীক মহিলা কবি স্যাফোর জীবন উচ্চপ্রশংসা করেন। তরুন নারীবাদী দৃস্টিতে দেখা ও লেখা কবি তার গ্রন্থে সমস্ত ধরণের স্বাধীনতা চান, যার জন্য তার বন্ধুদের কাছে তিনি স্যাফো নামে পরিচিত হন।তারপরে তিন বছর পর তার দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশ হয়, সেটা ছিল তার সকল কবিতার সংগ্রহ নাম ‘আইডিলস অব উইমেনহুড’, এইভাবে তিনি তার সাহিত্য যশে নারীবাদী কবি হিসাবে।
১৮৯৬ সালে ডাক্টার হোরাশিও ফ্রান্সিস নিনিয়ান স্কটের সাথে পরিচিত হন ও বিয়ে করেন। হোরাশিও উত্তর আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী, একজন স্কটিশ, তিনি রাজপরিবারের নিযুক্ত ডাক্তারদের মধ্যে একজন তরুন ডাক্তার ছিলেন।ক্যাথরীন হোরাশিওকে বিয়ে করে তাকে সাহায্য করা ও সন্তানদের দেখাশুনা করাতে ব্যস্ত হন লেখা বন্ধ করে দেন।
ছয় বছর পর, লন্ডনের উপর ডাক্তার স্কটের বিতৃষ্ণা জন্মাল, তার স্ত্রীকেও সেকথা বোঝালেন।তাদের তিন বছরের মেয়ে ও এক বছরের ছেলেকে নিয়ে লন্ডনের শেষ দক্ষিণ প্রান্তে, আইল অব ওয়াইট এর উত্তরে পশ্চিম কাউএসে চলে যান। ওটা একটা দেশ পাড়াগাঁ । সেখানে ডাক্তার হোরাশিও মেডিসিনে ও শল্য চিকিৎসায় দক্ষতা দেখান, রোগের নিরাময় করে সুনাম করেন।১৯০৪ সালে ক্যাথরীনের দ্বিতীয় ছেলে জন্ম গ্রহন করে।মিসেস ডসন-স্কট তখন তার রোজকার ঘরোয়া কাজ থেকে মুক্তি পান এবং দিন দিন ভাবনা চিন্তাহীন আরামে ও বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। তিনি আবার লেখা শুরু করার জন্য ভাবেন।১৯০৬ সালে, সাহিত্য ছেড়ে চলে যাবার পর ১৪ বছর পর, মিসেস ডসন স্কটের বয়স তখন ৪১ বছর, তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য স্টোরি অব অ্যানা’ প্রকাশ করেন ‘মিসেস স্যাফো’ ছদ্মনামে। দুবছর পর তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য বার্ডেন’ তার প্রকৃত নামে সি এ ডসন স্কট নামে প্রকাশ করেন।তারপর তিনি এত সৃজনশীল হন যে তিনি ছয় বছরের মধ্যে সাত খানি বই প্রকাশ করেন।পাঁচটা উপন্যাস, একটা কবিতার গ্রন্থ ও একটা অন্য ধরনের বই। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। ১৯১০ সাল নাগাদ স্কট পরিবার আবার লন্ডনের কাছে চলে যান। এবং মিসেস ডসন স্কট পরিনত কবি ও নতুন উপন্যাসিক হিসাবে সাহিত্যের লন্ডনে ফিরে এলেন।
১৯১৪ সালে, বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডাক্তার হোরাশিও রয়াল আর্মি মেডিসিন করপস এ যোগ দেন। তাকে তখন ফ্রান্সে পাঠানো হল। ঘরে তিনটি স্কুল শিশুর দায়িত্বে ক্যাথরীন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার একসপ্তাহ পর ক্যাথরীন তার অতিমাত্রার সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখালেন। টাইমস পত্রিকায় তিনি একটা পত্র লেখেন, তাতে তিনি একটা প্রস্তাব রাখেন যে মহিলারা সাধারণ মানুষের জন্য বা আধা মিলিটারিদের জন্য সংগঠন তৈরী করুক তাতে যুদ্ধকালীন সেবা শ্রশ্রুসা দেওয়া যাবে। অনেক লোক নাম লেখাবে।তখন অনেক লোক দেশের সর্বপ্রান্ত থেকে তাকে স্বাগত জানাল ও তাকেই প্রতিষ্ঠাতা হতে বললেন। এইভাবে ‘উইমেন’স ডিফেন্স রিলিফ করপ্স’ স্থাপিত হল। হাজার হাজার সদস্য যোগ দিলেন অনেক শাখা সংগঠন তৈরী হল। মোট কথা উদ্দেশ্য সার্থক। কিন্তু ক্যাথরীন সংগঠন অন্যের হাতে তুলে দেন কাজ চালিয়ে যাবার জন্য। তার ছিল মনে দেশপ্রেমের চাপ ও শান্তি। তিনি আরো উচ্চকিছু ভাবনায় ব্যস্ত হন।বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হন তিনি বিশ্বশান্তির কথা ভাবেন।তার মনযোগ চলে গেল আবার লেখা ও লেখকগনের দিকে।
মিসেস ডসন স্কট বিশেষ করে যত্ন নিতেন ও দয়া দেখাতেন তরূন লেখকদের জন্য। যাদের সমাজ সহ্য করতনা, যারা পুরানো প্রথাগত নিয়ম ও মূল্যবোধ ভেঙ্গে বিদ্রোহ দেখাতেন তাদের নতুন লেখা দিয়ে। তিনি নতুন উপন্যাসিকদের চায়ের আমন্ত্রন জানাতেন তাদের রিভিউ লিখে দিতেন, যারা আর্থিক দুর্বল তাদের ডেকে খেতে দিতেন ও কয়েক টিন ভর্তি খাবার দিয়ে দিতেন বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য।এইভাবে অনেক তরুনের সাথে বন্ধুত্ব করেন তারা তাকে মিসেস স্যাফো বলতেন। কখনো তিনি প্রতিভাবান তরূনকে তার প্রতিষ্ঠিত বন্ধুদের সাথে পরিচয় করে দিতেন, এবং যাদের মনে করতেন তাদের সাহিত্যে সম্ভাবনা আছে , তাদের তিনি তার পরিচিত সম্পাদকদের কাছে সুপারিশ করে পাঠাতেন। কখনো সাহিত্যের প্রতিনিধি বা প্রকাশকের কাছে। এইভাবে তিনি একটা ভাবনা খুঁজে পান, তিনি আগামীপ্রজন্মের লেখকদের চিহ্নিত করে একটা ক্লাব করতে চান, এবং করেন, নাম দেন ‘টু-মরো ক্লাব’।
তাতে তিনি ‘আগামীর লেখক’ দের এমন একটা অবস্থা ও সুযোগ করে দেন যেখানে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বিনিময় করতে পারবে, পড়াশুনা করতে পারবে, উন্নতি করতে পারবে বা তাদের অনুসন্ধান চালাতে পারবে। এবং এটা মিসেস ডসন স্কটের বাড়ি হতে তুলে নিয়ে গেলেন ক্লাবে, সেখানে সান্ধ্যভোজ হত, কোন বিষয়ের উপর বক্তৃতা হত, সভা সমাবেশ হত।
১৯১৭ এর বসন্তে ৫০ বছর বয়সী মিসেস স্যাফো টু-মরো ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এট তার দ্বিতীয় সংগঠন।এই সংগঠনই পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক পি.ই.এন. নামে বিদ্যমান। টুমরো ক্লাবের অর্থ ছিল এখানকার সদস্যরা আগামী কালের লেখক।যদিও অনেক লেখক বা তথাকথিত তরুণ সাহিত্যিক সেখানে সাহিত্যের তোষামোদকারী, বা জোকারের ভূমিকায় ছিল। এই ক্লাব তার প্রত্যেকটা সভার জন্য সেক্রেটারি নিয়োগ করত, প্রত্যেকটা বিষয়ে বক্তা থেকে চেয়ার পার্সন সব স্থির করত। এইসব স্থানে তরুন লেখকরা একে অপরের কাছে শধু শিখতনা বা যোগাযোগ রাখতনা তারা বড় বড় লেখকদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শও পেত। অনেকে দয়া করে নানা সাহায্যও করতেন। মিসেস স্যাফো, অধিকন্তু, তার পরিচিত বড় বড় সম্পাদক ও সাহিত্যের প্রতিনিধিদের সান্ধ্যভোজে আমন্ত্রণ করতেন আর তরুণ সাহিত্যিকদের তাদের সাথে পরিচয় করার সুযোগ দিতেন।
এই ক্লাবও খুবই সুন্দর ও সার্থক হয়ে উঠেছিল। মিসেস স্যাফোর পরিকল্পনা ও পরিচালনায়।১৯১৮ সাল থেকে রুটিন করে সাপ্তাহিকভাবে সান্ধ্যভোজের ও বক্তৃতার আসর জমতে লাগল। মিসেস স্যাফোর অস্টম উপন্যাসও এইসময় বের হল, তার নাম অয়াস্ট্রালস। এরপর প্রতি বছর একটা করে বই লিখতে লাগলেন তিনি। নভেম্বরে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল।ব্রিটিশরা বিজয়ী হল। যুদ্ধের জন্য যেসব পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল তারা আবার পুনরায় মিলিত হল।সবকিছুই তখন ভাল চলছিল।
লোকে বলে সুখ আসা মানে দুঃখ সেখানে ঝুকছে বা খুব সুখ দুখকে জন্ম দেয়।যুদ্ধ শেষ হলে কি হবে, যুদ্ধের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা মুশকিল। অনেক পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মিসেস স্যাফো ও তা্র পরিবারের আনন্দ স্বল্পস্থায়ী হল।ডাক্তার হোরাশিও স্কট সেনাবাহিনী থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন তার স্ত্রীর আবেগ তাড়না ও সামাজিকতার চাপ তার জীবনে অসহ্য।যদিও মিসেস স্যাফোর স্বামীর প্রতি ভালবাসা অনেক গভীর।মিসেস স্যাফো সম্ভবত পাড়াগায়ের ডাক্তারের স্ত্রী মিসেস ডসন স্কটের ভূমিকায় ফিরে যেতে পারেননি। ২০ বছরের বিবাহিত জীবনের ছেদ টেনে বিবাহবিচ্ছেদ করলেন খুব তারাতারি।এটাই হয়ত মিসেস স্যাফোর জীবনের বড় ব্যর্থতা এবং তিনি এটাকে আর বাঁচাতে পারলেননা। এই ঘটনা তাকে মনস্তাত্ত্বিকতায় নিয়ে গেল ও তিনি মনস্তত্ব নিয়ে গবেষনা শুরু করেন। এবং তার স্বামী মরে যাবার পরও তার আাত্মার সাথে যোগাযোগ করার জন্যঅনেক বছর চেস্টা করেন। তার লেখা ‘ফ্রম ফোর হু আর ডেড’ এরই ফসল হিসাবে সাত বছর পর প্রকাশিত হয়। তিনি একটি আধ্যাত্মিক সংগঠনও তৈরী করেন নাম ছিল ‘সারভাইবাল লিগ’।
আবেগের ও আধ্যাত্মতা ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ বস্তুত মিসেস স্যাফোকে খুব ভাল কিছু দিতে পারেনি। যুদ্ধের সময় প্রায় ৫বছর তিনি একা মা হয়ে সন্তান মানুষ করেন। কিন্তু এসব তার জীবনকে খুব পালটে দিতে পারেনি।ছেলে মেয়েরা প্রায় নিজেরাই এক একা মানুষ হয়েছে। বছরে নয় মাস তিনি লন্ডনে সাহিত্যও সামাজিক কাজের জন্য থাকতেন।সাপ্তাহিক টুমরো ক্লাব বাদে মাসে এক রবিবার বিকেলে তার মেয়েদের সাহায্যে একটা কর্মশালা বসাতেন।সেখানে নানা লোক আসতেন, প্রতিবেশী বা স্থানীয় লেখকরা, নতুন বা পুরানো বন্ধুরা আসতেন, ২০ জনের অধিক মানুষ জমায়েত হতেন।সাংবাদিক, লেখক, প্রকাশক সম্পাদক ... সবাই আসতেন।এইভাবে তার বৃত্ত ক্রমশঃ বৃহত্তর হচ্ছিল।
প্রত্যেক গ্রীস্মে তিনি তার সন্তানদের নিয়ে গ্রামের দিকে চলে যেতেন,করনওয়ালের লেভর্নাতে, সেখানে কোনো কূটীর তিন মাসের জন্য ভাড়া নিতেন, কখনো বন্ধুদের নিয়ে যেতেন এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য, চাষীদের খাবার, তাদের জীবন ইত্যাদী উপভোগ করতেন।
মিসেস স্যাফোর নাতনী মার্জরী অ্যান ওয়াট এক সন্ধ্যায় আড্ডায় খুবই আন্তরিক পরিবেশে মিসেস স্যাফোর জীবন বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বন্ধুদের কাছে অ্যামি ডসন স্কট ( ছোট, মোটা কিন্তু ভয়ঙ্কর) মিসেস স্যাফো নামে পরিচিত ছিলেন কারন তিনি সারাজীবন নারীবাদী ছিলেন--- তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্যাফো’ প্রকাশের পর গ্রীক চরিত্র স্যাফোকে তিনি ভীষন পছন্দ করতেন। স্যাফোর যৌনপছন্দগুলিই নয়, ২০০০ বছর আগে লেসবোস দ্বীপে নারীদের অধিকার নিয়ে তার লড়াই ও উদাহরণ পছন্দ করতেন।
মার্জরী অ্যান ওয়াট থেকে আমরা আরো জানতে পারিঃ অ্যামি ডসনের মা ও বাবা কড়া প্রকৃতির মানূষ ছিলেন। অ্যামি ছোটবেলা থাকতেই ছিলেন জেদী, চালাক ও ভাল করে অভিব্যক্ত করার মানূষ। তার বাবা মায়ের অসূখী বিয়ের সন্তান। প্রায়ই তিনি বাবা মায়ের সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়তেন।পরবর্তীকালে নাতনীর সাথে গল্প করেছেন, তার মা রুটি কাটার ছুরি নিয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকে তাড়া করতেন, তিনি বাড়ীর চারদিকে দৌড়ে পালাতেন আর তার মা তাকে অনুসরণ করে আসতেন। অল্প বয়সে অ্যামির মা মারা যান, তার বাবা আবার বিয়ে করেন। অ্যামিকে ছোট একটা বোর্ডিং স্কুলে স্থানান্তর করা হয়।
যদিও দেখতে শুনতে ভাল ছাত্রী ছিলেননা তার উপর বিদ্রোহী ভাব, তবু তিনি শ্রেণীকক্ষের সবার প্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম ছিলেন, সবাইকে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প বলে কাছে টেনে নিয়ে আসতেন।স্কুলে শেষ করে ১৮৮৪তে একজন অন্ধ প্রফেসরের সেক্রেটারির কাজ পান। সেখানেই তার প্রফেসরের পাঠাগার দেখে জীবনে সাহিত্যকে জীবিকা করার কথা ভাবেন।
ঐরকম সময়েই এক বিখ্যাত প্রকাশন কভেন্ট গার্ডেন পাব্লিশার – এর প্রকাশক উইলিয়াম হেইনম্যান এর সাথে পরিচিত হন। হেইনম্যান অ্যামির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে লন্ডনের বেড়ে উঠা বিশিস্ট সাহিত্যিক সমাজে অ্যামিকে পরিচিত করিয়ে দেন। বিশিস্ট সাহিত্যিকগনের মধ্যে ছিলেন H.G. Wells, W.B. Yeates, Miss Forster and Oscar Wilde। সাহস পেয়ে ১৮৮৯ সাল নাগাদ হেইনম্যান এর সহযোগীতায় নিবন্ধ, প্রবন্ধ , কবিতা ইত্যাদি লিখে তিনি কিছু পয়সাও উপায় করতে লাগলেন। তখনই ২১০ পাতার নারীবাদী কাব্যগ্রন্থ স্যাফো প্রকাশ করেন।
মার্জরী ওয়াট আরো বলেন, তার দিদা অ্যামি বুঝতে পারেন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে তিনি একটা বিশেষ সাহিত্যস্থানে অবস্থান অর্জন করেছেন।লাবন্যময়ী তরুণী হিসাবে বিভিন্ন সাহিত্য সমাবেশে, পার্টিতে তিনি ডাক পেতেন।তাকে লোকের ভাল লাগত। তিনি প্রচুর ডাক পেতেন। একটা মৌলিক ও আকর্ষনীয় মনের বহিঃপ্রকাশ মানুষ গ্রহন করল। ১৮৯৭ সালে বিয়ের পর তার সাহিত্যিক জীবন স্তব্দতায় ডুবে গেল,ডাক্তার স্বামী , ৩ টে বাচ্চা।এর ১৪ বছর পর আবার সাহিত্য জগতে ফিরে পুরানো সম্পর্কগুলি কে নতুন করে সাহিত্যে প্রবেশ। ২০ খানা উপন্যাস ছাড়া তিনি নাটক, সামাজিক ট্যাবু, পারিবারিক অশান্তি, ব্যভিচার ও বিয়ের আগে যৌন সংসর্গ এইসব আলোচ্য বিষয় নিয়ে প্রচুর লিখেছেন।
তার বিশেষ ৩টি পরিকল্পনার সবগুলিকেই বাস্তব রুপ দিতে পেরেছিলেন।
১৯১৪ সালে উইমেন্স ডিফেন্স রিলিফ কর্প্স সংগঠন করেন। ১৯১৭তে টু-মরো ক্লাব করেন। ১৯২১ তে আন্তর্জাতিক পেন করেন।
মার্জরি বলছেন,পীকাডেলির ফ্লোরেন্স রেস্তঁরাতে ১৯২১র অক্টোবর ৫ এ অ্যামি তার বন্ধুদের মধ্যে ৫৪ জনকে তোষামোদ করে, চোখ রাঙ্গিয়ে এক জায়গায় জড়ো করেছিলেন। জর্জ বানার্ড শ পরে মন্থব্য করেছিলেন, ‘ আমি যোগ দিয়েছিলাম কারণ গলসওয়ার্দি বলেছিলেন আমাকে করতেই হবে। তিনি মনে হচ্ছে যোগ দিয়েছিলেন কারন মিসেস ডসন স্কট বলেছিলেন তাকে যোগ দিতেই হবে।’ এতে বোঝা যায়,মিসেস ডসন স্কট অনেকটা কতৃত্বের সুর ও শাসনের ক্ষমতাও রাখতেন।
আর্নেস্ট রেমন্ড তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, অ্যামি অপরিহার্যভাবে স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা ও গনতন্ত্র পছন্দ করতেন এবং তার জন্য তিনি স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। তার জীবন সুন্দর ও টানাপোড়েনের ছিল, তার শারিরীক ও ভাবনার সৃস্টিরা তার জন্য গর্বিত মনে করবে।
২য় অংশঃ পেনের জন্ম
১৯২১ সালে শ্রীমতী স্যাফো’র টু-মরো ক্লাবের চারবছর পূর্ণ হল, ক্লাব খুব ভাল চলেছে। ১৯১৮ তে যুদ্ধোত্তর প্রথম উপন্যাস ওয়াসট্রল প্রকাশনার পর প্রতি বছর একটা করে আরো দুটি উপন্যাস বেরুল।তার চতুর্থ উপন্যাসও প্রকাশনার জন্য স্থির হয়ে গেল। জুলাই মাসে শ্রীমতি স্যাফো কর্ণওয়ালে গেলেন তার ‘গ্রীনস্টোনস’ উপন্যাস লিখে গ্রীস্ম কাটাবার জন্য সমুদ্র সৈকতে লেভর্ণা ভিলা ভাড়া নেন। তার মেয়ে মার্জোরী সব সময় তার সাথেই থাকত কিন্তু এবার সে থাকলনা। মার্জোরির তখন ২১ বছর, সে ওয়ার শ’তে ব্রিটিশ পাশপোর্ট কন্ট্রোল –এ এক বছর ধরে কাজ করছিল। তখন মা মেয়েতে প্রতি সপ্তাহে অনেক চিঠি চালাচালি হয়েছিল। পরে পেনে র ইতিহাস বলতে গিয়ে এই চিঠিগুলির প্রাসঙ্গিক বিষয় প্রকাশ করে ছিলেন।
আমার একটা বুদ্ধি এসেছে! নামীনামী লোকদের নিয়ে-- একটা সান্ধ্যভোজের মিলন স্থান। এই ব্যাপারটা আমি ভায়োলেটকে (হান্ট) বলব- ও আর আমি দুইজনে এটা করব। এতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অসুবিধা হবেনা মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৮টায় দ্য ফ্লোরেন্স রেস্তরাঁয়।
তার ঠিক ছয়দিন পর মার্জোরীর কাছে শ্রীমতীস্যাফো প্রথমবার তার ক্লাব লিখলেন পি. পি.ই.এন.- পোয়েট, প্লেরাইট, এডিটর এবং নভেলিস্ট, পরের চিথিতে সংক্ষিপ্ত করে পি. ই. এন. করে নেন। তার অনেক অনেক পরের চিঠিতে পেন ক্লাব বলে পরিষ্কার করে লিখতে শুরু করেন। এবং এই ক্লাবটার আন্তঃর্জাতিক করণের জন্য ভাবতে শুরু করেন।
শ্রীমতি স্যাফো মধ্য লন্ডনের পিকাডিলি সার্কাসের রুপার্ট স্ট্রিটের ফ্লোরেন্স রেস্তঁরায় আনুষ্ঠানিক ভাবে পেন ক্লাবের জন্য প্রথমবার সান্ধ্যভোজ দেন। ৫ ই অক্টোবর ১৯২১ সাল ৪৩ জন লেখক এই শুভ সূচনাতে পেনে যোগদান করতে এসেছিলেন। এই তারিখে যারা এসেছিলেন তারাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে সম্মান পেয়েছিলেন। শ্রীমতি স্যাফো ও মার্জোরী বাদে বাকী ৪১ জন হলেন
1. Arthur Beverley Baxter (1891-1964); 2. Victor Bridges (1878-1972); 3. Ethel Coxon (f) 4. Charles Seddon Evans (1883-1944); 5. John Farquharson (1882-?)¬; 6. John Galsworthy (1867-1933); 7. Walter Lionel George (1882-1926); 8. Muriel Morgan Gibbon (f); 9. Louis Golding (1895–1958); 10. Austin Harrison (1873-1928); 11. Edith Shackleton Heald (f, 1984-1976) 12. M.T. Hogg (f); 13. Percy Hord (f); 14. Isobel Violet Hunt (f, 1862-1942); 15. Edgar Alfred Jepson (1863-1938); 16. Fr[iniw]yd Tennyson Jesse (f, 1889-1958); 17. Sheila Kaye-Smith (f, 1887–1956); 18. Lamburn; 19. Mrs. Lamburn; 20. Lewis Rose McLeod (1875-?);
21. Arthur E. Mann (1876-1972); 22. Mrs. Elizabeth Craig Mann (1883-1980); 23. Ethel Colburn Mayne (f, 1870-1941); 24. Edgar Charles Middleton (1894-1939); 25. Mrs.Yevonde Middleton (1893-1975); 26. Elinor Mordaunt (1872-1942); 27. Hermon Ould (1885-1951); 28. Edward Raymond Thompson (1872-1928); 29. Hylda Rhodes (f); 30. Kathlyn Rhodes (f, 1878-1962); 31. Marion Ryan (f); 32. Horace Shipp (1891-1961); 33. May Sinclair (f, 1862 – 1946); 34. Stephen Southwold (1887-1964); 35. Winifred Stephens Whale (f, 1870–1944) 36. Muriel Stuart (f, 1885-1967); 37. Netta Syrett (f, 1865-1943); 38. Rebecca West (f, 1892-1983); 39. Kate Douglas Wiggin (f, 1856-1923); 40. Stanley Wrench; 41. Mrs.Violet Louise Stanley Wrench (1880-1966).
অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে মহিলা ছিলেন ২৫ জন আর পুরুষ ছিলেন ১৮ জন।সান্ধ্যভোজের আগে, মিসেস স্যাফো কিছুতেই গলসওয়ার্দিকে সভাপতি হোয়ার জন্য রাজী করাতে পারলেননা। তারপর অনেক আলোচনা হওয়ার পর তিনি একবছরের জন্য সভাপতি পদে থাকতে রাজী হন। তখন সেক্রেটারি শ্রীমতী স্যাফো ছাড়া আর কারুর হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তার স্বাস্থ্য ভাল না থাকার জন্য সেক্রেটারির সাম্মানিক পদে মার্জোরী হন আর ইংলিশ রিভিওর সম্পাদিকা অস্টিন হ্যারিসন সাম্মানিক কোষাধ্যক্ষ পদে বহাল হন। সান্ধ্যভোজের মধ্যেই কার্যকরী সমিতি তৈরী হল- হ্যারিসন, ম্যাক্লয়েড, ইভানস, শিপ, গোল্ডিং, ওয়েস্ট এবং মান তা্রা অন্তর্ভুভুক্ত হন। তার একসপ্তাহ পর প্রথম কার্যকরী সমিতির প্রথম সভা বসে লন্ডনে বেডফোর্ড স্কোয়ারে ইংলিশ রিভিও র অফিসে। হ্যারিসন চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত হন। সমিতি ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকার কিছু ব্যক্তিবর্গের সাথে পেন কেন্দ্র তাদের দেশে খোলার জন্য কথা চালাবার সিদ্ধান্তে উপস্থিত হল। বেশ কয়েকজন লেখকগনকে আমন্ত্রণ জানানো হল ইংলিশ পেনে যোগদান করার জন্য বা অন্যান্য দেশে সাম্মানিক সদস্য হওয়ার জন্য।
হ্যারিসন তার শক্ত নেতৃত্ব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হন। সমিতি বা পেন ক্লাব কমিটি গলসওয়ার্দীকে প্রথম সভা বা মিটিঙ্গএর পর চেয়ারম্যান হতে বলেন। তিনি (গলসওয়ার্দি) তার পরের সভা থেকে শীর্ষ আসনে বসা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠার পর অক্টোবরের শেষের দিকে পেন তার প্রথম সাধারন সান্ধ্যভোজ বসাল সেখানে ৭২ জন লোক এসেছিলেন। এসেছিলেন আমেরিকা থেকে, কানাডা থেকে এবং অন্যান্য দেশ থেকে।
১০ নভেম্বর,কমিটি তাদের তৃতীয় সভাতে ২৪জন নতুন সদস্যকে মেনে নেন। তাদের মধ্যে গিলবার্ট কিঠ চেস্টারটন এবং যোশেফ কনরাডও ছিলেন। মার্জোরী ডসন স্কটকে বিদেশের নামীনামী লেখকদের সাম্মানিক সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রন পাঠাতে বলা হল।
১৯২২ এর জানুয়ারীতে সাম্মানিক সদস্য হওয়ার জন্য বিশ্ববিখ্যাত লোকেরা আমন্ত্রন গ্রহন করেন, তাদের মধ্যে ১২ জন ছিলেন লরিয়েট ও ৫জন নোবেল পাওয়া সাহিত্যিক। এবং ভবিষ্যৎ লরিয়েটদের মধ্যে Selma Lagerlöf (1909), Maurice Maeterlinck (1911), Romain Rolland (1915), Knut Hamsun (1920). Anatole France (1921) and William Butler Yeats (1923). অন্যান্য লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন Thomas Hardy,Johan Bojer,Geoge Brandes, Martin Andersen Nexø, Vicente Blasco Ibáñez, George William Russell and Artur Schnitzler.
ইংলিশ পেন এইভাবে বড় হচ্ছিল আর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছিল তখন খুব কস্ট হচ্ছিল এই ছোট্ট কমিটিকে সামলাতে। মিসেস স্যাফো আবার পুরানো প্রস্তাবকে উত্থাপন করেন যে আন্তর্জাতিক কমিটি স্থাপন হোক তারা দেশের বাইরের সংগঠন চালাবে আর যোগাযোগ বজায় রাখবে। কার্যকরী কমিটি মিসেস স্যাফোর প্রস্তাব মেনে নিল। আন্তর্জাতিক কমিটির কর্তা হবেন গলসওয়ার্দী মহাশয় ও মিসেস স্যাফো। তাদের সাহায্য করবেন লন্ডনের কিছু কার্যকরী কমিটির সদস্য যাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে। Shipp, প্রতিষ্ঠা সদস্য Stephens Whale, এবং তিনজন নতুন সদস্য William Archer, Rosita Forbes এবং Edward Shanks. মার্জরী ছিলেন এটারও সেক্রেটারি। ১৯২২ এর ফেব্রুয়ারীতে ইংলিশ পেনের আন্তর্জাতিক কমিটির প্রথম সভা বসল মিসেস স্যাফোর বাড়িতে। এই সময় ফরাসী কেন্দ্র মোটামুটি হয়ে গেছে আর বাইরের দেশের অন্য কেন্দ্রগুলি প্রস্তুতি নিচ্ছে।
১৯২৩ সালের পয়লা মে, লন্ডনের হোটেল সিসিল-এ আন্তর্জাতিক পেন- এর প্রথম সান্ধ্যভোজের আসর বসাল। আন্তর্জাতিক পেনের হেডকোয়ার্টার ইংলিশ পেন বাদে ১০টি দেশের ১১টি পেন কেন্দ্র যোগ দিল। বার্সিলোনা (স্পেন),মাদ্রিদ (স্পেন), বেলজিয়াম, চেকোশ্লাভিকিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রেন্স, ইতালী, নরওয়ে, রোমানিয়া, সুইডেন এবং আমেরিকা।তারা ১৬৪ জন অংশগ্রহন কারী প্রতিনিধি পাঠালেন। ইংল্যান্ডে আন্তর্জাতিক পেনের আদর্শগুলিকে মিসেস স্যাফো পরিমার্জনা করলেন। তিনি পেনের মা। তার অনুপ্রেরণায় পেন দেশে ও বাইরে বিস্তৃতি লাভ করতে লাগল। সাথী লেখকগন তাদের পারস্পরিক বোঝাবুঝির মধ্যদিয়ে পেনে যোগদান করতে লাগলেন।
অ্যামি ডসন স্কট যেদিন বললেন ‘ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে’,১৯২১ সালে, তার আজ ৯০ বছর। তার সুদুর প্রসারী স্বপ্ন, লেখকদের আন্তর্জাতিক সমাবেশ ও সম্পর্ক গড়া আজ বিশাল কর্ম কান্ডে পরিনত হয়েছে। দেশের প্রতি দেশের, জাতির প্রতি জাতির, বোঝাবুঝির, শান্তির একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক মঞ্চ আজ স্বীকৃত মানবাধিকার সংগঠন। আজ পৃথিবীর ১০৫টি দেশে ১৪৫টি কেন্দ্র।
মার্জরি ওয়াট বলেছেন, পেনের কেন্দ্রের মূল ছিলেন জন গলসওয়ার্দি। তিনি ছিলেন তখনকার দিনে অতিসুপরিচিত ও বিখ্যাত মানুষ।তার সাথে নানা দেশের যোগাযোগ ছিল। অ্যামি তাকে পরিচালক মন্ডলিতে যে করেই হোক আনতে পেরেছিলেন, পেনে যোগ দিয়ে তিনি দেশবিদেশের যোগাযোগই সাধন করেন নি। খুব তারাতারি তিনি পেন চলার গতিশক্তি রুপে আবির্ভূত হন।প্রচুর দেশভ্রমন করেন, তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে নিংড়ে দেশে বিদেশে অনেক সদস্য সংখ্যা বাড়ান। অ্যামি ও গলসওয়ার্দির মধ্যে অনেক চরিত্রগত ভিন্নতা ছিল।গলসওয়ার্দি একজন আইনজ্ঞ, সাবধানী, জ্ঞানী, আবেগে নড়েননা—এদিকে অ্যামি আবেগমথিত,উদ্দীপিত, অসাধারণ ও জেদী--- ওরা একে অপরের পরিপূরক। অ্যামির সাথে গলসওয়ার্দির মত পার্থক্য ছিল প্রচুর।তবু তাকে সম্মান করতেন, তিনি জানতেন গলসওয়ার্দির কথার যুক্তি থাকে এবং তাকে গলসওয়ার্দির কথা শুনে চলতেই হবে।
সাইমন বার্কার বলে একজনের কথায় জানা যায়, কি করে জন গলসওয়ার্দি পেনের সাথে জড়িয়ে পড়লেন।
তিনি প্রথম থেকেই পেনের সমর্থনে ছিলেন এবং এটা বুঝতে পেরেছিলেন তরুন লেখকদের তাদের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে এসে জনসাধারনের বৃত্তে একে অপরের সাথে কথাবার্তা বলা দরকার। গলসওয়ার্দির উদ্দীপনার মূলে ছিল একটা ভাবনা। সে বিশ্বাস করে লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের একটা সামাজিক দায়িত্ব আছে , অন্য লেখকদের প্রতি দায়িত্ব আছে। আছে দিনের শেষে সামাজিক বিষয় কেন্দ্র করে কথা বলা।
জন গলসওয়ার্দিকে যদিও আমরা চিনি ‘ফরসাইট সাগা’র জন্য কিন্তু তার জনপ্রিয়তার ব্যাপ্তি এত বিস্তৃত ছিল যে যখন তিনি তার কাজের জন্য আমেরিকায় নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন, জাহাজের ডক থেকে তাকে লুকিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।কারণ তাকে দেখার জন্য এত লোকের ভিড় জমে ছিল—এটা বিটলসদের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন বিটলসরা প্রথমবার আমেরিকায় গেছিলেন তখন এমন হয়েছিল।
গলসওয়ার্দীর একটা সোস্যাল ইমেজ ছিল, তার নিজের বিয়ের জন্য লন্ডন ক্লাব থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন, তাই তিনি চাইছিলেন সামাজিক পটভুমিকায় তার সম্মানকে পুনরোদ্ধার করতে। আর লোকে ভাবছিল তার ব্যক্তিগত জীবনে কিছু ঠিকঠাক চলছেনা ।তখন তিনি নারীর অধিকার নিয়ে লড়তেন। যুদ্ধের সময় তিনি কারাগার সংশোধনের জন্য আইন সংস্কার করেন। অনেক কিছুই একা একা করেন। অনেক ভাল কিছু করতে চান অবশেষে দৃড়সংকল্পিত হয়ে লেখায় ফিরে আসেন। সাত্রে যেমন বলেছিলেন, “তরোয়াল ধরার অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে আগেই কলম হাতে ধর”।
গলসওয়ার্দি কথাটার মানে পি.ই.এন. -এ নিয়েগেছিলেন।
পেন বা পি.ই.এন
পেন একটি বেসরকারী লেখকদের বিশ্বসংগঠন, বিশ্বের প্রথম মানবাধিকার সংগঠন, ইউনেস্কো বা ইউ.এন.ই.এস.সি.ও র বিশেষ পরামর্শদাতা, ইউনাইটেড নেশন এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপদেস্টা।
১৯২১ সালে এর শুরু হয়। উপলক্ষ ছিল যা তা হলঃ
১. লেখকদের মধ্যে বৌদ্ধিক সহযোগীতা ও পরস্পরের মধ্যে বোঝাবুঝি।To promote intellectual co-operation and understanding among writers;
২. লেখকদের একটা বিশ্বসংগঠন করা যেখানে বেড়ে উঠা পৃথিবী বা ক্রমউন্নতমান পৃথিবীর সংস্কৃতিতে সাহিত্যের মূল কাজ কি হবে তা স্থির করা এবং To create a world community of writers that would emphasize the central role of literature in the development of world culture; and,
৩. আধুনিক পৃথিবীতে দেখা যাচ্ছে লেখা ও লেখকদের অনেক হয়রানি জীবনের হুমকী, ভয়, বিপদ আসছে, তা থেকে লেখা ও লেখকগনকে বাঁচানো। To defend literature against the many threats to its survival which the modern world poses.
সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
‘আন্তঃর্জাতিক পি. ই.এন.’ এই সংগঠনটি আজ থেকে ৯১ বছর আগে- ইউনাইটেড কিংডমের লন্ডনে - ১৯২১ সালে শুরু হয়। শুরুতে নামটি ছিল ‘পি. ই. এন’ বা পেন। শুরুর চার বছরের মধ্যে ইউরোপে ২৫টি কেন্দ্র স্থাপন হয়। এবং ১০ বছরের মধ্যে ১৯৩১ সালের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকা ও চীন সহ প্রচুর কেন্দ্র স্থাপন হয়। কেন্দ্রগুলি স্বাধীন ও স্বশাসিত।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ – ১৮) পৃথিবীর প্রায় দেশগুলিতে সূচনীয় ও ঘনায়মান অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠছিল, তখন পি.ই.এন. এর সদস্য হয়েছিল অন্তর্ভুক্ত দেশবৃন্দঃ আর্জেন্টিনা,অস্ট্রেলিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, মিশর, ভারত, ইরাক, জাপান, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, প্যালেস্টাইন, উরুগুয়ে, আমেরিকা এবং অন্যান্য। উত্তর ইউরোপের বা স্ক্যান্ডিনাভিয়ান দেশগুলি সহ পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ ও সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাস্ক, ক্যাটালান এবং ইদ্দিশ কেন্দ্রগুলিরও প্রতিনিধি ছিল।
আজ আট দশক পর, ব্যপক ও ভিন্ন ধরণের সংস্কৃতি, ভাষার সজ্জা ও বিস্তৃতি নিয়ে, ইউরোপের বাইরে ১৪৫টি কেন্দ্র নিয়ে ‘আন্তঃর্জাতিক পি.ই.এন’ গর্ব করার মতো একটি বিশ্বসংগঠন।
পি. ই. এন. হল বিশ্বে প্রথম বেসরকারী সংগঠন এবং যে কয়টি প্রথম আন্তঃর্জাতিক সংগঠন মানুষের অধিকার নিয়ে উকালতি করছে তার মধ্যে অন্যতম। নিশ্চিতভাবে, বিস্তৃত পৃথিবীর প্রথম লেখকদের সংগঠন ----এবং প্রথম সংগঠন যারা চিহ্নিত করেছিল একটি নীতি – বাক্স্বাধীনতা ও সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য বিষয়— একটি নীতি যা তারা উপরে ধরে রেখেছে আজও, তাদের চার্টারে বা সাংবিধানিক ধারায় স্থান দিয়েছে। ১৯২৬ সালে এই নীতির সূত্রপাত এবং ২২ বছর লেগেছিল তা নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে ১৯৪৮ সালের কোপেনহাগেন কংগ্রেসে চিরস্থায়ীভাবে গৃহীত হয়।
প্রায় কঠিন এক শতাব্দী ধরে প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গড়ে উঠা ও প্রাদুর্ভাবে, -- তারপর ঠান্ডাযুদ্ধের মধ্যদিয়ে এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন এবং আজকের বিস্তারিত পৃথিবীর ভিন্নপ্রকৃতির ও সুক্ষ্ম ভিন্ন আবহাওয়ায় আন্তঃর্জাতিক পেন সাহিত্য ও স্বাধীনতাকে নিয়ে নানা টানাপোড়েনে চলেছে, দ্বন্ধ, পরীক্ষা, নানা আপত্তি অগ্রাহ্য ইত্যাদি করে সামলে আসছে। আজকের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় মোড়গুলির প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এবং এর নেতৃত্ববর্গ- প্রত্যেকযুগের সেরা ব্যক্তিগণ, বিখ্যাত ও বুদ্ধিজীবিগণ সহ, সকল অক্লান্ত ও উৎসর্গিত সদস্যবৃন্দেরা - লেখা, পড়া ও প্রকাশ করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়ার লক্ষ্যে সংগ্রাম করে চলছেন বিশ্বসংস্কৃতির কেন্দ্রগুলিতে।
পেন বা পি.ই.এন শব্দটা এসেছে ইংরাজী শব্দ পোয়েটস (কবি),এসেয়িস্টস (প্রাবন্ধিক),নভেলিস্টস (উপন্যাসিক) (পরে যোগ করা হয়েছে প্লেরাইটস ( নাট্যকার) ও এডিটরস (সম্পাদক দের) মূলতঃ মসীজীবি বা লেখক—কবি, নাট্যকার, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিকগণের সমাবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সদস্য সংখ্যা বেড়ে উঠার জন্য পি.ই.এন. আন্তঃর্জাতিক পেন বা পি.ই.এন নামে খ্যাতি লাভ করে।
প্রথমে ছিল একটা নতুন ধরণের ডিনার (সান্ধ্যভোজের) ক্লাব।
ক্যাথরিন অ্যামি ডসন স্কট, একজন ব্রিটিশ কবি, নাট্যকার এবং শান্তিবাদ কর্মী মহিলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবের পর সকল লেখকদের একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। প্রথমদিকে এটা একটা সান্ধ্যভোজের আসর ছাড়া কিছুই ছিলনা, শুধু ছিল একটু জায়গা যেখানে লেখকরা সামাজিকতা বা নিজেদের মধ্যে ভাবনা-চিন্তার বিনিময় করতেন। পেন ক্লাব ইউরোপের অন্যান্য রাজ্যে স্থাপন হবে এবং লেখকরা সেখানে গিয়ে নতুন বন্ধুদের সাথে ভাবনা বিনিময় করবেন এইরকম ভাবনা চিন্তা ছিল। ডসন স্কটের সান্ধ্যভোজের অতিথিবর্গের মধ্যে একজন ছিলেন জন গলসওয়ার্দি, যিনি পেন এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হন,যিনি একটা আন্তঃর্জাতিক আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন---- যা নরনারী লেখকগনের জন্য বহু রাজ্যের জাতিগনের একটি ঐক্য সমাবেশ মঞ্চ।
রাজনীতির প্রশ্নে
পেন তার প্রথম কংগ্রেস উপস্থাপনা করে ১৯২৩ সালে, ১১ টি কেন্দ্র তাতে যোগ দেয়। ১৯২০ সালের থেকেই পেন তার চরিত্রে অদ্বিতীয়, সংস্কৃতি, ভাষা বা রাজনৈতিক দ্বিমত তোয়াক্কা না করে সকল লেখকগনদের একজায়গায় আনতে পেরেছিল।পেন অরাজনৈতিক সংগঠন কিন্তু এইসময়টাতে রাজনৈতিক পারদ চাপানউতর সবাই লক্ষ্য করছিল। বস্তুত, একটি প্রতিষ্ঠাকালীন নীতি—কোন অবস্থাতেই কোন রাজনীতি পেন ক্লাবে চলবেনা, এরকম ছিল। এতেই কাজ হয়েছিল, পেনে সবাই বাক্স্বাধীনতা, শান্তি ও বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিল কিন্তু কোন রাজনৈতিক বিতর্ক ছিলনা।
১৯৩৩ সালে, যাইহোক, এই ভাবনাটাকে পরীক্ষায় এনে ফেলেছিল কারণ জার্মানীতে জাতীয় সমাজবাদীর ছায়া ফেলেছিল। ডুব্রবনিকে পেন কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা ঐ বছর বুঝেছিল রাস্ট্রিয় দমন ও অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ উপেক্ষা করে চলা কঠিন।
এমনকি ১৯২৬ সালে, বার্লিনে পেন কংগ্রেসে জার্মান পেন ও পেনের সাধারন সভ্যদের মধ্যে ভাবনার সংঘাত ও দুঃচিন্তার পারদ চড়ছিল। অনেক তরুন জার্মান লেখক- বার্টোল্ট ব্রেখট, আলফ্রেড ডব্লিন এবং রবার্ট মিউসিল তাদের অন্যতম ছিলেন---তারা বলছিলেন জার্মান পেন তাদের দেশে সত্যিকারের জার্মান সাহিত্য প্রতিনিধিত্ব করছেনা। তারা প্রেসিডেন্ট গলস ওয়ার্দির সাথে দেখা করেন তাদের হতাশার কথা জানালেন। নাট্যকার আরনেস্ট টলার বললেন রাজনীতি উপেক্ষা করে চলবেনা, রাজনীতি পেনে থাকবে---এটা সর্বত্র এবং এর প্রভাব থাকবেই।
বই পোড়ানো, পোড়ানোর আক্রোশ
১৯৩২ সালের বুদাপেস্ট কংগ্রেসে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য একটা আবেদন পাঠানো হয়েছিল সকল দেশের সরকারের কাছে। গলস ওয়ার্দী তখন পাঁচটি বক্তব্য ঘোষণা করেছিলেন- এটা ছিল পেন বিকাশের আরেক ধাপ যেটা আজ আমরা পেন চার্টারে দেখতে পাই।
তার পরের বছর রাজনৈতিক টানাপোড়েন অভুতপূর্বভাবে বেড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ উপন্যাসিক এইচ জি ওয়েলস ১৯৩৩ সালে গলস ওয়ার্দির মৃত্যুর পর পেনের প্রেসিডেন্ট হন। জার্মানীর নাজীরা তখন বই পোড়ানো উৎসবে মত্ত, ওয়েলস এর বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালান। জার্মান পেন প্রতিবাদ করতে পারলনা, ব্যর্থ হল। অধিকন্তু, টলারকে (তিনি এক ইহুদী ছিলেন) ডুব্রভনিকের কংগ্রেসে বলা থেকে বিরত করার চেস্টা করল। তারপরেই পেন থেকে জার্মান পেনের সদস্য পদ থেকে খারিজ করে দিল। বিবৃতিতে পেন বলল যদি জার্মান পেন তাদের জাতীয়তাবাদী আদর্শে চলে তবে তাদের পেন সংগঠন কে বাতিল করা হল।
জেল বন্দি লেখকদের দুটো পুরানো ঘটনাঃ
১৯৩০ সালের শেষের দিকে লেখকগনের পক্ষে সক্রিয়ভাবে আবেদন করা বা প্রতিবাদ করা পেনের অন্যতম কাজ হয়ে উঠেছিল। হাঙ্গেরীতে জন্ম আর্থার কোয়েস্টলার, তখন তিনি সাঙবাদিক ছিলেন, তিনি ফ্যাসিস্ট স্পেনে বন্দী ছিলেন, তাকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া হয়েছিল। পেন তার মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হলে তিনি মুক্তি পান।
স্পেনের মহান কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা অন্যদিকে তার অ্যারেস্ট হওয়ার পরই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তাকে বাঁচানো যায়নি। কারন পেন টেলিগ্রাম যখন পেয়েছে তখন দেরী হয়ে গেছে। ১৯৩৭ সালে প্যারিসে পেন কংগ্রেসে লোরকার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
যুদ্ধোত্তর পেনের দিনঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পেন পুরো অন্যরকম হয়ে গেল। আগে এর সৃস্টির পেছনে ভাবনা ছিল ক্লাব হিসাবে জাতি, ধর্ম ও বিশ্বাস যাইহোকনা কেন লেখকদের স্বাগতম জানানো। যুদ্ধের সময় লন্ডনে ও নিউইয়র্কে নির্বাসিত লেখকদের নিয়ে নতুন দল প্রতিষ্ঠিত হল। পেনে কিছু চাপও সৃস্টি হচ্ছিল যেমন যারা জার্মানে জাতীয় সমাজতন্ত্র সমর্থন করছিল বা অন্যত্র যারা এসব করছিল তাদের সাথে পেন কিভাবে ব্যবস্থা নেবে। এবং ক্রমশ বেড়ে উঠা আন্তঃর্জাতিক পেন সমাজ নিয়মিতভাবে কিভাবে যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে বা দরকারের সময় তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ রাখবে, এই প্রয়োজন থেকেই আন্তর্জাতিক পেনে ইগজিকিউটিভ কমিটি গঠিত হয়।
১৯৪৯ সালে আমেরিকান পেনের সংকল্পিত ভাবনায় পেন বিশ্বের লেখকদের প্রতিনিধি হিসাবে ‘ইউনাইটেড নেশনে’ পরামর্শদাতার মর্যাদা পায়। এবং ইউনাইটেড নেশনের শরিক।
১৯৫০ সালে পেন সদস্যগন যেসব লেখকদের লেখা বা মতামতের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা জেল দণ্ড পেয়েছেন তাদের মামলাগুলি পরীক্ষানীরিক্ষার জন্য একটি কমিটি করার প্রয়োজন ভাবেন। তার ফল হিসেবে একটি কমিটি ‘রাইটার্স ইন প্রিজন’ গঠিত হয় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে। আস্তে আস্তে পেন আন্তঃর্জাতিক মহলে প্রভাব বিস্তার শুরু করল।
ওলে শয়িঙ্কা এবং মেরিলিন মনরোর স্বামীর চিঠিঃ
১৯৬৭ সালে আমেরিকার নাট্যকার আর্থার মিলারের প্রেসিডেন্সীশিপের সময় পেন নাইজিরিয়ার কাছে একটা আবেদন রেখেছিল এমন একজন নাট্যকারের পক্ষে যিনি তখন তার দেশের বাইরে পরিচিতি পাননি। ওলে শয়িঙ্কাকে তার দেশের সর্বোচ্চ কর্তা জেনারেল ইয়াকুবু গোওন তাড়াতাড়ি মেরে ফেলার জন্য চিহ্নিত করেছিল। তখন বাইয়াফ্রান পৃথক হওয়া নিয়ে সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছিল।
এক ব্যবসায়ী পেনের থেকে একটি চিঠি গোঅন এর কাছে নিয়ে গেছিলেন,শয়িংকার মুক্তির দাবিতে এবং বললেন কে চিঠিটা লিখেছে্ন, বস্তুত যিনি মেরিলিন মনরোকে বিয়ে করেছিলেন ( ১৯৫৬ সালে আর্থার মিলার মেরিলিন মনরোকে বিয়ে করেছিলেন) গোঅন যখন নিশ্চিত হন সে একই ব্যক্তি মনরোর স্বামী ও পত্রলেখক শয়িঙ্কার মুক্তি চাইছেন তখন গোঅন তার বন্দীকে মুক্ত করে দেন। শয়িঙ্কা তারপর দেশ ছেড়ে যান, অবশ্যই, পৃথিবীর বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার হিসাবে ১৯৮৬ সালে সাহিত্যের জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পান।
রাশিয়ানরা নারাজ
মিলার রাশিয়ার লেখকদের সাথে দেখা করতে রাশিয়ায় যান, এবং মিলারকে বলা হয় যে তারা পেনের সদস্য হতে চান কিন্তু প্রধান বাধা হল পেনের চার্টার। মিলার পরিষ্কার করে বললেন যে তিনি এখানে চার্টার অদল বদল করে তাদের উপযুক্ত করার জন্য আসেননি। তিনি এসেছেন দেখতে কিসে পেন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। যাইহোক তিনি এটা নিশ্চিত করেন যে পুব-পশ্চিম বিভাজন খোলা রাখা আছে। কিন্তু রাশিয়ান পেন ১৯৮৮ এর আগে সৃস্টি হয়নি। তার পরের তিন দশক—২০০০ সাল অব্দি পেন পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌছে গেছে ও তার শুভ ছাপ রেখে গেছে। পেনের আওয়াজকে জাতীয় বা আন্তঃর্জাতীক স্তরে মূল্য দেওয়া হয় বা সম্মান জানানো হয়, কিছু বিষয়ে যেমন - বাক্স্বাধীনতায়, অনুবাদ সাহিত্যে, মহিলা লেখকগনের সমস্যায় এবং কি করে সকল লেখকদের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর দিয়ে একত্রে আনা যায় ইত্যাদি। সেন্সরশিপ, মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা, জেলবন্দী এবং খুন—এসবের বিরুদ্ধে পেন ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
রাশদি প্রসঙ্গ
১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল, লেখকগন , প্রশাসকগন বা আন্তঃর্জাতিক সংগঠনগুলি অবগত আছে যে পেন জেল বা মৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন লেখকদের হয়ে কাজ করছে। ১৯৮৯ সালে,বুকার পুরষ্কার বিজয়ী সালমান রাশদী তার বই স্যাটানিক ভার্সেস এর লেখার চেয়ে বেশী আন্তঃর্জাতিক দৃস্টি আকর্ষন করেছিলেন,কারণ, ইরাণের আয়াতোল্লা খোমেনির ধর্মীয় ফতোয়া লেখকের মৃত্যু জারী করেন , তাদের মতে ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে সালমানের বইয়ে। সালমান বাধ্য হয়ে আড়ালে লুকিয়ে যান। এরপর রাশদীর দুর্দশা সাহিত্যের এক ইতিহাস হয়ে উঠে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত লেখক হিসাবে তিনি এক প্রতীক হয়ে যান। পেন ফতোয়া তুলে নেবার অভিযান চালায় পৃথিবীর সর্বত্র এবং প্রকাশকদের বইটি বিক্রীর সমর্থন দেয়। রাশদী আজ অব্দি আন্তঃর্জাতিক পেনের সদস্য এবং আমেরিকান পেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট।
কেন সারো-উইয়াঃ
১৯৯৫ সালে,পেনের চোখ আবার নাইজিরিয়ার দিকে ঘুরে গেল। পেন ৯০ সাল থেকে একটা মামলা লক্ষ্য করছিল। উপন্যাসিক,নাট্যরুপকার ও মানবাধিকার কর্মী কেন সারো-উইয়া । নাইজার ব-দ্বীপের কাছে ওগোনি জাতির লোকদের হয়ে প্রচারভিযান চালাচ্ছিল কেন সারো-ঊইয়া, তার জন্য তাকে ১৯৯২ সালে প্রশাসন প্রথম গ্রেপ্তার করল।। ওগোনিরা বৃহত্তরভাবে স্বয়ং শাসন বা স্বায়ত্বশাসন চাইছিল, এবং কেন সারো-উইয়া বহুজাতিক পেট্রোলিয়াম সংস্থা রয়াল ডাচ শেল এর কাছে আবেদন রাখছিল যে তারা যেন তেল নিকাশ করতে গিয়ে ওগোনি ল্যান্ডের পরিবেশ যা ক্ষতি করেছে তার দায়িত্ব নেয়। তার কয়েক মাস পর তাকে ছেড়ে দেয়। ১৯৯৩ সালে আবার একমাসের জন্য একটি শান্তিপ্রিয় প্রতিবাদের জন্য গ্রেপ্তার করে, ঐ আন্দোলনটা নাইজিরিয়ান সিকিউরিটি ফোর্সেস ভয়াবহ ভাবে দমন করেছিল। ১৯৯৪ সালে ৪ জন ওগোনি সর্দার মারা গেল মিলিটান্ট ওগোনিদের হাতে। সারো উইয়াকে আগেরবার এই সর্দারদের সাথে সভায় বসতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসন আবার তাকে ওগোনি ডানপন্থীদের ১৪ জনের সাথে গ্রেপ্তার করল। তাকে খুনের অপরাধে অভিযুক্ত করা হল। ১৯৯৫ এর ১০ মার্চ, পেনের আন্তঃর্জাতিক প্রচার অভিযান চলা সত্ত্বেও কেন সারো-উইয়া কে মারা হল। তারপর আন্তঃর্জাতিক চিৎকার, চাপ আসতে লাগল নাইজিরিয়ার সরকারের উপর। ১৯৯৬ সালে শেল কোম্পানীর বিরুদ্ধে নাইজিরিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা রুজু করা হল কেন সারো-উইয়া হত্যা সহ। ২০০৯ সালে শেল কোম্পানী ১৫.৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরন দিতে রাজী হল।
২০০৬ সালের অক্টোবরে, অ্যানা পলিটস্কোভায়া, একজন উচ্চ স্তরের রাশিয়ান সাংবাদিক, স্বাধীন খবরের কাগজে ‘নোভায়া গ্যাজেটা’ কাজ করতেন। চেচনিয়ার যুদ্ধের উপর তিনি খবর লিখতেন। তাকে মৃত্যুর হুমকী দেওয়া হচ্ছিল। একদিন তাকে তার বাড়ীর (অ্যাপার্টমেন্টের) লিফটে খুন করা অবস্থায় পাওয়া গেল। পেন তারপর থেকে খুনীকে আদালতে তোলার সর্বচেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তার তিন মাস পর, ২০০৭ এর জানূয়ারীতে, আমেরিকান তুর্কী লেখক এবং খবরের কাগজের সম্পাদক হ্রান্ট দিঙ্ক কে ইস্তানবুলে মারাত্মক ভাবে গুলি করে মারল। ডিঙ্ক তূর্কী সংবিধানের ৩০১ ধারায় তার লেখায় তুর্কীজাতি্কে অপমান করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত ছিল। ডিঙ্ক তুর্কী সরকারকে ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ান গনহত্যাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছিল।
পেন দিঙ্ক এর পরিবারকে সাহায্য করেছিল এবং তার হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার চাপ দিল। এক তরুন তূর্কী উগ্রজাতীয়তাবাদীকে ধরা হল ও ডিঙ্ক কে খুন করার অপরাধে কোর্ট মৃত্যুদন্ড দিল,অন্যান্য দের সাজা দিল।
এই হল আন্তঃর্জাতিক পেন। আজও ডসন স্কট ও গলস ওয়ার্দীর আওয়াজ শোনা যায়। লেখকরা শক্তিশালী হচ্ছে,তারূন্যতা পাচ্ছে, নির্ভীক হচ্ছে। সবই আন্তঃর্জাতিক পেনের অভয়ে।
পেনের কাজ সঠিক ভাবে পালনের জন্য চারটি কমিটি আছেঃ ১. শান্তির জন্য লেখকদের কমিটি ২.জেলবন্দী লেখকদের কমিটি ৩. নারী লেখকদের কমিটি ৪.অনুবাদ ও ভাষাগত অধিকারের কমিটি।
‘পেন ইন্টারনেশনাল’ নামে পেন একটি ম্যাগাজিন ষান্মাসিকভাবে প্রকাশ করে। তাতে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে সমকালীন মৌলিক লেখা সংগৃহীত হয়। উঠতি লেখকগন থেকে প্রতিষ্ঠিত লেখকরা লেখা পাঠান। এই ম্যাগাজিনটি ১৯৫০ সালে শুরু হয়, নাম ছিল ‘বুলেটিন অব সিলেক্টেড বুকস’, তাতে পৃথিবীর সাহিত্যের উপর আলো ফেলে সাহিত্য মতামত প্রকাশ হত।পরে তাতে যোগ হল প্রবন্ধ, ছোট গল্প ও কবিতা।বর্তমানে ম্যাগাজিনটির যে আদল তা ১৯৮২ সাল থেকে।
চার্টার
১.সাহিত্য, যদিও কোনো জাতির, বা যেকোন ভৌগোলিক স্থানে তার উৎপত্তি, তার কোনো সীমানা নেই, সে সর্বত্র অবাধ বিচরণ করবে। রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক কোনো সংঘাত তাকে স্পর্শ করবেনা।
২.যেকোনো অবস্থায়- বিশেষ করে যুদ্ধের সময়, জাতীয় বা রাজনৈতিক আবেগ শিল্পকর্ম, পাঠাগার, বা পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারের সূত্রে পাওয়া বস্তুতে কখনো যেন স্পর্শ না করে
৩.পেনের সদস্যগন তাদের ক্ষমতা বা প্রভাব যা আছে সবসময় ভিন্নজাতিগনের মধ্যে শ্রদ্ধা ও পরস্পরের বোঝাবুঝিতে ব্যবহার করবে, তারা শ্রেণি,বর্ণবৈষম্য বা জাতির প্রতি ঘৃণা বর্জন করার শপথ নেবে। এবং পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করার জন্য মানবিক আদর্শ গুলি তুলে ধরবে।
৪.পেন জাতি ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভাবনাকে ব্যঘাতহীনভাবে পৌছে দেওয়া বা চালনা করা সমর্থন করে। সদস্যগন মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশ দমনকে বা বিরুদ্ধাচরণকে বাধা দেওয়ার বা প্রতিবাদ করার শপথ নেয়, তারা তাদের দেশের মধ্যে বা সমাজের মধ্যে অভিব্যক্তি প্রকাশের সকল মাধ্যমের স্বাধীনতাকে নিরাপত্তা দেয়।
৫.পেন ঘোষনা করে স্বাধীন বক্তব্য বা মুক্ত প্রকাশ।শান্তির সময় কোনো বিধিনিষেধকরণ চলবেনা। পেন বিশ্বাস করে প্রচন্ড উন্নত সংগঠিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পৃথিবীতে সরকারের, প্রশাসনের, বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মুক্ত সমালোচনা আবশ্যিক প্রয়োজন। এবং স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছায় সংযত থাকাও তাই সদস্যগন শপথ নেয় কোনো রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থে কেউ যদি সত্যের অপলাপ করে, স্বেচ্ছায় ভুলতথ্য পরিবেশন করে, মিথ্যা বলে তার বিরোধিতা করা।
লেখা ঃ অ্যালবার্ট অশোক
পি.ই.এন. ইনটারনেশনাল বা ইন্টারনেশনাল পেন এর প্রাথমিক প্রতিষ্ঠাতা হলেন ক্যাথরীন অ্যামি ডসন স্কট, বিয়ের আগে তার নাম ছিল ক্যাথরীন অ্যামি ডসন। তারপর তাকে ডাকা হত মিসেস স্যাফো, পরে বলা হত মাদার অব পেন বা বাংলায় ‘পেনের মা’।
৩১শে আগস্ট ১৮৬৫ সালে ক্যাথরীন অ্যামি ডসন স্কট দক্ষিণ লন্ডনে, ডালউইচের গথিক লজে জন্মান।
১৯৩৪ সালের ৪ নভেম্বর লন্ডনে হাস্পাতালে মারা যান।
ক্যাথরীনের বাবা এবেনেযার ডসন ছিলেন একজন ইট প্রস্তুতকারক, তার মা ছিলেন স্কটিশ বংশোদ্ভুত ক্যাথ্রীন আর্মস্ট্রংগ।ক্যাথরীন ১৮ বয়সে উচ্চবিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে তার নিজস্ব জীবিকা শুরু করেন। প্রফেসর জেনিংস বলে একজন অন্ধ বয়োজেষ্ঠ মানুষের সেক্রেটারী হন। প্রফেসর জেনিংসের জন্য অন্যান্য কাজ সহ কখনো উচ্চস্বরে কয়েক ঘন্টা ধরে বই পড়তে হত। জেনিংস তাকে পছন্দ করতেন কারন তার উচ্চারণ ছিল পরিষ্কার এবং মিস্টি। তিনি তাকে শুধু কিছু জ্ঞান লজিক ও গ্রীক ভাষা শেখান নি তাকে অন্যের উপর কথা বার্তায় চালচলনে সঠিক বিচার বিশ্লেষন করা- ‘স্কেপ্টিসিজম’ ও শেখান। তাকে তখনকার দিন অনূযায়ী ৪০০ পাউন্ড বছরে মাইনে দিতেন যেখানে একজন কেরাণী বছরে ১০০ পাউন্ড উপায় করত আর একজন প্রফেসর বছরে ৭০০ থেকে ১০০০ পাউন্ড উপায় করে। চার বছর পর প্রফেসর মারা গেলে ২২ বছরের ক্যাথরীন তার সকল সঞ্চয় নিয়ে লন্ডনে চলে এলেন। সেখানে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। খবরের কাগজে তার কবিতা , ছোটগল্প ইত্যাদি প্রকাশ করে লেখার পেশা বা জীবিকা শুরু করেন।কস্টেমস্টে যা পেতেন তাই দিয়ে দিন কাটিয়ে দিতেন। তার যা সঞ্চয় ছিল তাতে হাত দিতেননা।
১৯৮৮ সালে ২৩ বছর বয়সী ক্যাথরীন সি এ ডসন নামে একটি বই প্রকাশ করেন ‘শ্যারাডজ ফর হোম অ্যাক্টিং’।
এক বছর পর তার নিজের টাকায় তার প্রথম সাহিত্য সৃস্টি ‘স্যাফো’ নামে ২১০ পাতার এক লম্বা মহাকাব্য প্রকাশ করেন, এতে গ্রীক মহিলা কবি স্যাফোর জীবন উচ্চপ্রশংসা করেন। তরুন নারীবাদী দৃস্টিতে দেখা ও লেখা কবি তার গ্রন্থে সমস্ত ধরণের স্বাধীনতা চান, যার জন্য তার বন্ধুদের কাছে তিনি স্যাফো নামে পরিচিত হন।তারপরে তিন বছর পর তার দ্বিতীয় গ্রন্থ প্রকাশ হয়, সেটা ছিল তার সকল কবিতার সংগ্রহ নাম ‘আইডিলস অব উইমেনহুড’, এইভাবে তিনি তার সাহিত্য যশে নারীবাদী কবি হিসাবে।
১৮৯৬ সালে ডাক্টার হোরাশিও ফ্রান্সিস নিনিয়ান স্কটের সাথে পরিচিত হন ও বিয়ে করেন। হোরাশিও উত্তর আয়ারল্যান্ডের অধিবাসী, একজন স্কটিশ, তিনি রাজপরিবারের নিযুক্ত ডাক্তারদের মধ্যে একজন তরুন ডাক্তার ছিলেন।ক্যাথরীন হোরাশিওকে বিয়ে করে তাকে সাহায্য করা ও সন্তানদের দেখাশুনা করাতে ব্যস্ত হন লেখা বন্ধ করে দেন।
ছয় বছর পর, লন্ডনের উপর ডাক্তার স্কটের বিতৃষ্ণা জন্মাল, তার স্ত্রীকেও সেকথা বোঝালেন।তাদের তিন বছরের মেয়ে ও এক বছরের ছেলেকে নিয়ে লন্ডনের শেষ দক্ষিণ প্রান্তে, আইল অব ওয়াইট এর উত্তরে পশ্চিম কাউএসে চলে যান। ওটা একটা দেশ পাড়াগাঁ । সেখানে ডাক্তার হোরাশিও মেডিসিনে ও শল্য চিকিৎসায় দক্ষতা দেখান, রোগের নিরাময় করে সুনাম করেন।১৯০৪ সালে ক্যাথরীনের দ্বিতীয় ছেলে জন্ম গ্রহন করে।মিসেস ডসন-স্কট তখন তার রোজকার ঘরোয়া কাজ থেকে মুক্তি পান এবং দিন দিন ভাবনা চিন্তাহীন আরামে ও বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেন। তিনি আবার লেখা শুরু করার জন্য ভাবেন।১৯০৬ সালে, সাহিত্য ছেড়ে চলে যাবার পর ১৪ বছর পর, মিসেস ডসন স্কটের বয়স তখন ৪১ বছর, তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য স্টোরি অব অ্যানা’ প্রকাশ করেন ‘মিসেস স্যাফো’ ছদ্মনামে। দুবছর পর তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য বার্ডেন’ তার প্রকৃত নামে সি এ ডসন স্কট নামে প্রকাশ করেন।তারপর তিনি এত সৃজনশীল হন যে তিনি ছয় বছরের মধ্যে সাত খানি বই প্রকাশ করেন।পাঁচটা উপন্যাস, একটা কবিতার গ্রন্থ ও একটা অন্য ধরনের বই। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় ১৯১৪ সালে। ১৯১০ সাল নাগাদ স্কট পরিবার আবার লন্ডনের কাছে চলে যান। এবং মিসেস ডসন স্কট পরিনত কবি ও নতুন উপন্যাসিক হিসাবে সাহিত্যের লন্ডনে ফিরে এলেন।
১৯১৪ সালে, বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডাক্তার হোরাশিও রয়াল আর্মি মেডিসিন করপস এ যোগ দেন। তাকে তখন ফ্রান্সে পাঠানো হল। ঘরে তিনটি স্কুল শিশুর দায়িত্বে ক্যাথরীন। যুদ্ধ শুরু হওয়ার একসপ্তাহ পর ক্যাথরীন তার অতিমাত্রার সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখালেন। টাইমস পত্রিকায় তিনি একটা পত্র লেখেন, তাতে তিনি একটা প্রস্তাব রাখেন যে মহিলারা সাধারণ মানুষের জন্য বা আধা মিলিটারিদের জন্য সংগঠন তৈরী করুক তাতে যুদ্ধকালীন সেবা শ্রশ্রুসা দেওয়া যাবে। অনেক লোক নাম লেখাবে।তখন অনেক লোক দেশের সর্বপ্রান্ত থেকে তাকে স্বাগত জানাল ও তাকেই প্রতিষ্ঠাতা হতে বললেন। এইভাবে ‘উইমেন’স ডিফেন্স রিলিফ করপ্স’ স্থাপিত হল। হাজার হাজার সদস্য যোগ দিলেন অনেক শাখা সংগঠন তৈরী হল। মোট কথা উদ্দেশ্য সার্থক। কিন্তু ক্যাথরীন সংগঠন অন্যের হাতে তুলে দেন কাজ চালিয়ে যাবার জন্য। তার ছিল মনে দেশপ্রেমের চাপ ও শান্তি। তিনি আরো উচ্চকিছু ভাবনায় ব্যস্ত হন।বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হন তিনি বিশ্বশান্তির কথা ভাবেন।তার মনযোগ চলে গেল আবার লেখা ও লেখকগনের দিকে।
মিসেস ডসন স্কট বিশেষ করে যত্ন নিতেন ও দয়া দেখাতেন তরূন লেখকদের জন্য। যাদের সমাজ সহ্য করতনা, যারা পুরানো প্রথাগত নিয়ম ও মূল্যবোধ ভেঙ্গে বিদ্রোহ দেখাতেন তাদের নতুন লেখা দিয়ে। তিনি নতুন উপন্যাসিকদের চায়ের আমন্ত্রন জানাতেন তাদের রিভিউ লিখে দিতেন, যারা আর্থিক দুর্বল তাদের ডেকে খেতে দিতেন ও কয়েক টিন ভর্তি খাবার দিয়ে দিতেন বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য।এইভাবে অনেক তরুনের সাথে বন্ধুত্ব করেন তারা তাকে মিসেস স্যাফো বলতেন। কখনো তিনি প্রতিভাবান তরূনকে তার প্রতিষ্ঠিত বন্ধুদের সাথে পরিচয় করে দিতেন, এবং যাদের মনে করতেন তাদের সাহিত্যে সম্ভাবনা আছে , তাদের তিনি তার পরিচিত সম্পাদকদের কাছে সুপারিশ করে পাঠাতেন। কখনো সাহিত্যের প্রতিনিধি বা প্রকাশকের কাছে। এইভাবে তিনি একটা ভাবনা খুঁজে পান, তিনি আগামীপ্রজন্মের লেখকদের চিহ্নিত করে একটা ক্লাব করতে চান, এবং করেন, নাম দেন ‘টু-মরো ক্লাব’।
তাতে তিনি ‘আগামীর লেখক’ দের এমন একটা অবস্থা ও সুযোগ করে দেন যেখানে তারা নিজেদের মধ্যে কথা বিনিময় করতে পারবে, পড়াশুনা করতে পারবে, উন্নতি করতে পারবে বা তাদের অনুসন্ধান চালাতে পারবে। এবং এটা মিসেস ডসন স্কটের বাড়ি হতে তুলে নিয়ে গেলেন ক্লাবে, সেখানে সান্ধ্যভোজ হত, কোন বিষয়ের উপর বক্তৃতা হত, সভা সমাবেশ হত।
১৯১৭ এর বসন্তে ৫০ বছর বয়সী মিসেস স্যাফো টু-মরো ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। এট তার দ্বিতীয় সংগঠন।এই সংগঠনই পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক পি.ই.এন. নামে বিদ্যমান। টুমরো ক্লাবের অর্থ ছিল এখানকার সদস্যরা আগামী কালের লেখক।যদিও অনেক লেখক বা তথাকথিত তরুণ সাহিত্যিক সেখানে সাহিত্যের তোষামোদকারী, বা জোকারের ভূমিকায় ছিল। এই ক্লাব তার প্রত্যেকটা সভার জন্য সেক্রেটারি নিয়োগ করত, প্রত্যেকটা বিষয়ে বক্তা থেকে চেয়ার পার্সন সব স্থির করত। এইসব স্থানে তরুন লেখকরা একে অপরের কাছে শধু শিখতনা বা যোগাযোগ রাখতনা তারা বড় বড় লেখকদের কাছ থেকে তাদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শও পেত। অনেকে দয়া করে নানা সাহায্যও করতেন। মিসেস স্যাফো, অধিকন্তু, তার পরিচিত বড় বড় সম্পাদক ও সাহিত্যের প্রতিনিধিদের সান্ধ্যভোজে আমন্ত্রণ করতেন আর তরুণ সাহিত্যিকদের তাদের সাথে পরিচয় করার সুযোগ দিতেন।
এই ক্লাবও খুবই সুন্দর ও সার্থক হয়ে উঠেছিল। মিসেস স্যাফোর পরিকল্পনা ও পরিচালনায়।১৯১৮ সাল থেকে রুটিন করে সাপ্তাহিকভাবে সান্ধ্যভোজের ও বক্তৃতার আসর জমতে লাগল। মিসেস স্যাফোর অস্টম উপন্যাসও এইসময় বের হল, তার নাম অয়াস্ট্রালস। এরপর প্রতি বছর একটা করে বই লিখতে লাগলেন তিনি। নভেম্বরে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল।ব্রিটিশরা বিজয়ী হল। যুদ্ধের জন্য যেসব পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল তারা আবার পুনরায় মিলিত হল।সবকিছুই তখন ভাল চলছিল।
লোকে বলে সুখ আসা মানে দুঃখ সেখানে ঝুকছে বা খুব সুখ দুখকে জন্ম দেয়।যুদ্ধ শেষ হলে কি হবে, যুদ্ধের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতি এড়িয়ে চলা মুশকিল। অনেক পরিবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মিসেস স্যাফো ও তা্র পরিবারের আনন্দ স্বল্পস্থায়ী হল।ডাক্তার হোরাশিও স্কট সেনাবাহিনী থেকে বাড়ি ফিরে দেখেন তার স্ত্রীর আবেগ তাড়না ও সামাজিকতার চাপ তার জীবনে অসহ্য।যদিও মিসেস স্যাফোর স্বামীর প্রতি ভালবাসা অনেক গভীর।মিসেস স্যাফো সম্ভবত পাড়াগায়ের ডাক্তারের স্ত্রী মিসেস ডসন স্কটের ভূমিকায় ফিরে যেতে পারেননি। ২০ বছরের বিবাহিত জীবনের ছেদ টেনে বিবাহবিচ্ছেদ করলেন খুব তারাতারি।এটাই হয়ত মিসেস স্যাফোর জীবনের বড় ব্যর্থতা এবং তিনি এটাকে আর বাঁচাতে পারলেননা। এই ঘটনা তাকে মনস্তাত্ত্বিকতায় নিয়ে গেল ও তিনি মনস্তত্ব নিয়ে গবেষনা শুরু করেন। এবং তার স্বামী মরে যাবার পরও তার আাত্মার সাথে যোগাযোগ করার জন্যঅনেক বছর চেস্টা করেন। তার লেখা ‘ফ্রম ফোর হু আর ডেড’ এরই ফসল হিসাবে সাত বছর পর প্রকাশিত হয়। তিনি একটি আধ্যাত্মিক সংগঠনও তৈরী করেন নাম ছিল ‘সারভাইবাল লিগ’।
আবেগের ও আধ্যাত্মতা ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ বস্তুত মিসেস স্যাফোকে খুব ভাল কিছু দিতে পারেনি। যুদ্ধের সময় প্রায় ৫বছর তিনি একা মা হয়ে সন্তান মানুষ করেন। কিন্তু এসব তার জীবনকে খুব পালটে দিতে পারেনি।ছেলে মেয়েরা প্রায় নিজেরাই এক একা মানুষ হয়েছে। বছরে নয় মাস তিনি লন্ডনে সাহিত্যও সামাজিক কাজের জন্য থাকতেন।সাপ্তাহিক টুমরো ক্লাব বাদে মাসে এক রবিবার বিকেলে তার মেয়েদের সাহায্যে একটা কর্মশালা বসাতেন।সেখানে নানা লোক আসতেন, প্রতিবেশী বা স্থানীয় লেখকরা, নতুন বা পুরানো বন্ধুরা আসতেন, ২০ জনের অধিক মানুষ জমায়েত হতেন।সাংবাদিক, লেখক, প্রকাশক সম্পাদক ... সবাই আসতেন।এইভাবে তার বৃত্ত ক্রমশঃ বৃহত্তর হচ্ছিল।
প্রত্যেক গ্রীস্মে তিনি তার সন্তানদের নিয়ে গ্রামের দিকে চলে যেতেন,করনওয়ালের লেভর্নাতে, সেখানে কোনো কূটীর তিন মাসের জন্য ভাড়া নিতেন, কখনো বন্ধুদের নিয়ে যেতেন এবং প্রাকৃতিক দৃশ্য, চাষীদের খাবার, তাদের জীবন ইত্যাদী উপভোগ করতেন।
মিসেস স্যাফোর নাতনী মার্জরী অ্যান ওয়াট এক সন্ধ্যায় আড্ডায় খুবই আন্তরিক পরিবেশে মিসেস স্যাফোর জীবন বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বন্ধুদের কাছে অ্যামি ডসন স্কট ( ছোট, মোটা কিন্তু ভয়ঙ্কর) মিসেস স্যাফো নামে পরিচিত ছিলেন কারন তিনি সারাজীবন নারীবাদী ছিলেন--- তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্যাফো’ প্রকাশের পর গ্রীক চরিত্র স্যাফোকে তিনি ভীষন পছন্দ করতেন। স্যাফোর যৌনপছন্দগুলিই নয়, ২০০০ বছর আগে লেসবোস দ্বীপে নারীদের অধিকার নিয়ে তার লড়াই ও উদাহরণ পছন্দ করতেন।
মার্জরী অ্যান ওয়াট থেকে আমরা আরো জানতে পারিঃ অ্যামি ডসনের মা ও বাবা কড়া প্রকৃতির মানূষ ছিলেন। অ্যামি ছোটবেলা থাকতেই ছিলেন জেদী, চালাক ও ভাল করে অভিব্যক্ত করার মানূষ। তার বাবা মায়ের অসূখী বিয়ের সন্তান। প্রায়ই তিনি বাবা মায়ের সাথে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়তেন।পরবর্তীকালে নাতনীর সাথে গল্প করেছেন, তার মা রুটি কাটার ছুরি নিয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকে তাড়া করতেন, তিনি বাড়ীর চারদিকে দৌড়ে পালাতেন আর তার মা তাকে অনুসরণ করে আসতেন। অল্প বয়সে অ্যামির মা মারা যান, তার বাবা আবার বিয়ে করেন। অ্যামিকে ছোট একটা বোর্ডিং স্কুলে স্থানান্তর করা হয়।
যদিও দেখতে শুনতে ভাল ছাত্রী ছিলেননা তার উপর বিদ্রোহী ভাব, তবু তিনি শ্রেণীকক্ষের সবার প্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম ছিলেন, সবাইকে অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প বলে কাছে টেনে নিয়ে আসতেন।স্কুলে শেষ করে ১৮৮৪তে একজন অন্ধ প্রফেসরের সেক্রেটারির কাজ পান। সেখানেই তার প্রফেসরের পাঠাগার দেখে জীবনে সাহিত্যকে জীবিকা করার কথা ভাবেন।
ঐরকম সময়েই এক বিখ্যাত প্রকাশন কভেন্ট গার্ডেন পাব্লিশার – এর প্রকাশক উইলিয়াম হেইনম্যান এর সাথে পরিচিত হন। হেইনম্যান অ্যামির ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে লন্ডনের বেড়ে উঠা বিশিস্ট সাহিত্যিক সমাজে অ্যামিকে পরিচিত করিয়ে দেন। বিশিস্ট সাহিত্যিকগনের মধ্যে ছিলেন H.G. Wells, W.B. Yeates, Miss Forster and Oscar Wilde। সাহস পেয়ে ১৮৮৯ সাল নাগাদ হেইনম্যান এর সহযোগীতায় নিবন্ধ, প্রবন্ধ , কবিতা ইত্যাদি লিখে তিনি কিছু পয়সাও উপায় করতে লাগলেন। তখনই ২১০ পাতার নারীবাদী কাব্যগ্রন্থ স্যাফো প্রকাশ করেন।
মার্জরী ওয়াট আরো বলেন, তার দিদা অ্যামি বুঝতে পারেন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে তিনি একটা বিশেষ সাহিত্যস্থানে অবস্থান অর্জন করেছেন।লাবন্যময়ী তরুণী হিসাবে বিভিন্ন সাহিত্য সমাবেশে, পার্টিতে তিনি ডাক পেতেন।তাকে লোকের ভাল লাগত। তিনি প্রচুর ডাক পেতেন। একটা মৌলিক ও আকর্ষনীয় মনের বহিঃপ্রকাশ মানুষ গ্রহন করল। ১৮৯৭ সালে বিয়ের পর তার সাহিত্যিক জীবন স্তব্দতায় ডুবে গেল,ডাক্তার স্বামী , ৩ টে বাচ্চা।এর ১৪ বছর পর আবার সাহিত্য জগতে ফিরে পুরানো সম্পর্কগুলি কে নতুন করে সাহিত্যে প্রবেশ। ২০ খানা উপন্যাস ছাড়া তিনি নাটক, সামাজিক ট্যাবু, পারিবারিক অশান্তি, ব্যভিচার ও বিয়ের আগে যৌন সংসর্গ এইসব আলোচ্য বিষয় নিয়ে প্রচুর লিখেছেন।
তার বিশেষ ৩টি পরিকল্পনার সবগুলিকেই বাস্তব রুপ দিতে পেরেছিলেন।
১৯১৪ সালে উইমেন্স ডিফেন্স রিলিফ কর্প্স সংগঠন করেন। ১৯১৭তে টু-মরো ক্লাব করেন। ১৯২১ তে আন্তর্জাতিক পেন করেন।
মার্জরি বলছেন,পীকাডেলির ফ্লোরেন্স রেস্তঁরাতে ১৯২১র অক্টোবর ৫ এ অ্যামি তার বন্ধুদের মধ্যে ৫৪ জনকে তোষামোদ করে, চোখ রাঙ্গিয়ে এক জায়গায় জড়ো করেছিলেন। জর্জ বানার্ড শ পরে মন্থব্য করেছিলেন, ‘ আমি যোগ দিয়েছিলাম কারণ গলসওয়ার্দি বলেছিলেন আমাকে করতেই হবে। তিনি মনে হচ্ছে যোগ দিয়েছিলেন কারন মিসেস ডসন স্কট বলেছিলেন তাকে যোগ দিতেই হবে।’ এতে বোঝা যায়,মিসেস ডসন স্কট অনেকটা কতৃত্বের সুর ও শাসনের ক্ষমতাও রাখতেন।
আর্নেস্ট রেমন্ড তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, অ্যামি অপরিহার্যভাবে স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা ও গনতন্ত্র পছন্দ করতেন এবং তার জন্য তিনি স্বেচ্ছাচারী ছিলেন। তার জীবন সুন্দর ও টানাপোড়েনের ছিল, তার শারিরীক ও ভাবনার সৃস্টিরা তার জন্য গর্বিত মনে করবে।
২য় অংশঃ পেনের জন্ম
১৯২১ সালে শ্রীমতী স্যাফো’র টু-মরো ক্লাবের চারবছর পূর্ণ হল, ক্লাব খুব ভাল চলেছে। ১৯১৮ তে যুদ্ধোত্তর প্রথম উপন্যাস ওয়াসট্রল প্রকাশনার পর প্রতি বছর একটা করে আরো দুটি উপন্যাস বেরুল।তার চতুর্থ উপন্যাসও প্রকাশনার জন্য স্থির হয়ে গেল। জুলাই মাসে শ্রীমতি স্যাফো কর্ণওয়ালে গেলেন তার ‘গ্রীনস্টোনস’ উপন্যাস লিখে গ্রীস্ম কাটাবার জন্য সমুদ্র সৈকতে লেভর্ণা ভিলা ভাড়া নেন। তার মেয়ে মার্জোরী সব সময় তার সাথেই থাকত কিন্তু এবার সে থাকলনা। মার্জোরির তখন ২১ বছর, সে ওয়ার শ’তে ব্রিটিশ পাশপোর্ট কন্ট্রোল –এ এক বছর ধরে কাজ করছিল। তখন মা মেয়েতে প্রতি সপ্তাহে অনেক চিঠি চালাচালি হয়েছিল। পরে পেনে র ইতিহাস বলতে গিয়ে এই চিঠিগুলির প্রাসঙ্গিক বিষয় প্রকাশ করে ছিলেন।
আমার একটা বুদ্ধি এসেছে! নামীনামী লোকদের নিয়ে-- একটা সান্ধ্যভোজের মিলন স্থান। এই ব্যাপারটা আমি ভায়োলেটকে (হান্ট) বলব- ও আর আমি দুইজনে এটা করব। এতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অসুবিধা হবেনা মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৮টায় দ্য ফ্লোরেন্স রেস্তরাঁয়।
তার ঠিক ছয়দিন পর মার্জোরীর কাছে শ্রীমতীস্যাফো প্রথমবার তার ক্লাব লিখলেন পি. পি.ই.এন.- পোয়েট, প্লেরাইট, এডিটর এবং নভেলিস্ট, পরের চিথিতে সংক্ষিপ্ত করে পি. ই. এন. করে নেন। তার অনেক অনেক পরের চিঠিতে পেন ক্লাব বলে পরিষ্কার করে লিখতে শুরু করেন। এবং এই ক্লাবটার আন্তঃর্জাতিক করণের জন্য ভাবতে শুরু করেন।
শ্রীমতি স্যাফো মধ্য লন্ডনের পিকাডিলি সার্কাসের রুপার্ট স্ট্রিটের ফ্লোরেন্স রেস্তঁরায় আনুষ্ঠানিক ভাবে পেন ক্লাবের জন্য প্রথমবার সান্ধ্যভোজ দেন। ৫ ই অক্টোবর ১৯২১ সাল ৪৩ জন লেখক এই শুভ সূচনাতে পেনে যোগদান করতে এসেছিলেন। এই তারিখে যারা এসেছিলেন তারাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে সম্মান পেয়েছিলেন। শ্রীমতি স্যাফো ও মার্জোরী বাদে বাকী ৪১ জন হলেন
1. Arthur Beverley Baxter (1891-1964); 2. Victor Bridges (1878-1972); 3. Ethel Coxon (f) 4. Charles Seddon Evans (1883-1944); 5. John Farquharson (1882-?)¬; 6. John Galsworthy (1867-1933); 7. Walter Lionel George (1882-1926); 8. Muriel Morgan Gibbon (f); 9. Louis Golding (1895–1958); 10. Austin Harrison (1873-1928); 11. Edith Shackleton Heald (f, 1984-1976) 12. M.T. Hogg (f); 13. Percy Hord (f); 14. Isobel Violet Hunt (f, 1862-1942); 15. Edgar Alfred Jepson (1863-1938); 16. Fr[iniw]yd Tennyson Jesse (f, 1889-1958); 17. Sheila Kaye-Smith (f, 1887–1956); 18. Lamburn; 19. Mrs. Lamburn; 20. Lewis Rose McLeod (1875-?);
21. Arthur E. Mann (1876-1972); 22. Mrs. Elizabeth Craig Mann (1883-1980); 23. Ethel Colburn Mayne (f, 1870-1941); 24. Edgar Charles Middleton (1894-1939); 25. Mrs.Yevonde Middleton (1893-1975); 26. Elinor Mordaunt (1872-1942); 27. Hermon Ould (1885-1951); 28. Edward Raymond Thompson (1872-1928); 29. Hylda Rhodes (f); 30. Kathlyn Rhodes (f, 1878-1962); 31. Marion Ryan (f); 32. Horace Shipp (1891-1961); 33. May Sinclair (f, 1862 – 1946); 34. Stephen Southwold (1887-1964); 35. Winifred Stephens Whale (f, 1870–1944) 36. Muriel Stuart (f, 1885-1967); 37. Netta Syrett (f, 1865-1943); 38. Rebecca West (f, 1892-1983); 39. Kate Douglas Wiggin (f, 1856-1923); 40. Stanley Wrench; 41. Mrs.Violet Louise Stanley Wrench (1880-1966).
অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে মহিলা ছিলেন ২৫ জন আর পুরুষ ছিলেন ১৮ জন।সান্ধ্যভোজের আগে, মিসেস স্যাফো কিছুতেই গলসওয়ার্দিকে সভাপতি হোয়ার জন্য রাজী করাতে পারলেননা। তারপর অনেক আলোচনা হওয়ার পর তিনি একবছরের জন্য সভাপতি পদে থাকতে রাজী হন। তখন সেক্রেটারি শ্রীমতী স্যাফো ছাড়া আর কারুর হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তার স্বাস্থ্য ভাল না থাকার জন্য সেক্রেটারির সাম্মানিক পদে মার্জোরী হন আর ইংলিশ রিভিওর সম্পাদিকা অস্টিন হ্যারিসন সাম্মানিক কোষাধ্যক্ষ পদে বহাল হন। সান্ধ্যভোজের মধ্যেই কার্যকরী সমিতি তৈরী হল- হ্যারিসন, ম্যাক্লয়েড, ইভানস, শিপ, গোল্ডিং, ওয়েস্ট এবং মান তা্রা অন্তর্ভুভুক্ত হন। তার একসপ্তাহ পর প্রথম কার্যকরী সমিতির প্রথম সভা বসে লন্ডনে বেডফোর্ড স্কোয়ারে ইংলিশ রিভিও র অফিসে। হ্যারিসন চেয়ারম্যান হিসাবে নিযুক্ত হন। সমিতি ইউরোপে ও উত্তর আমেরিকার কিছু ব্যক্তিবর্গের সাথে পেন কেন্দ্র তাদের দেশে খোলার জন্য কথা চালাবার সিদ্ধান্তে উপস্থিত হল। বেশ কয়েকজন লেখকগনকে আমন্ত্রণ জানানো হল ইংলিশ পেনে যোগদান করার জন্য বা অন্যান্য দেশে সাম্মানিক সদস্য হওয়ার জন্য।
হ্যারিসন তার শক্ত নেতৃত্ব প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হন। সমিতি বা পেন ক্লাব কমিটি গলসওয়ার্দীকে প্রথম সভা বা মিটিঙ্গএর পর চেয়ারম্যান হতে বলেন। তিনি (গলসওয়ার্দি) তার পরের সভা থেকে শীর্ষ আসনে বসা শুরু করেন। প্রতিষ্ঠার পর অক্টোবরের শেষের দিকে পেন তার প্রথম সাধারন সান্ধ্যভোজ বসাল সেখানে ৭২ জন লোক এসেছিলেন। এসেছিলেন আমেরিকা থেকে, কানাডা থেকে এবং অন্যান্য দেশ থেকে।
১০ নভেম্বর,কমিটি তাদের তৃতীয় সভাতে ২৪জন নতুন সদস্যকে মেনে নেন। তাদের মধ্যে গিলবার্ট কিঠ চেস্টারটন এবং যোশেফ কনরাডও ছিলেন। মার্জোরী ডসন স্কটকে বিদেশের নামীনামী লেখকদের সাম্মানিক সদস্য হওয়ার জন্য আমন্ত্রন পাঠাতে বলা হল।
১৯২২ এর জানুয়ারীতে সাম্মানিক সদস্য হওয়ার জন্য বিশ্ববিখ্যাত লোকেরা আমন্ত্রন গ্রহন করেন, তাদের মধ্যে ১২ জন ছিলেন লরিয়েট ও ৫জন নোবেল পাওয়া সাহিত্যিক। এবং ভবিষ্যৎ লরিয়েটদের মধ্যে Selma Lagerlöf (1909), Maurice Maeterlinck (1911), Romain Rolland (1915), Knut Hamsun (1920). Anatole France (1921) and William Butler Yeats (1923). অন্যান্য লেখকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন Thomas Hardy,Johan Bojer,Geoge Brandes, Martin Andersen Nexø, Vicente Blasco Ibáñez, George William Russell and Artur Schnitzler.
ইংলিশ পেন এইভাবে বড় হচ্ছিল আর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছিল তখন খুব কস্ট হচ্ছিল এই ছোট্ট কমিটিকে সামলাতে। মিসেস স্যাফো আবার পুরানো প্রস্তাবকে উত্থাপন করেন যে আন্তর্জাতিক কমিটি স্থাপন হোক তারা দেশের বাইরের সংগঠন চালাবে আর যোগাযোগ বজায় রাখবে। কার্যকরী কমিটি মিসেস স্যাফোর প্রস্তাব মেনে নিল। আন্তর্জাতিক কমিটির কর্তা হবেন গলসওয়ার্দী মহাশয় ও মিসেস স্যাফো। তাদের সাহায্য করবেন লন্ডনের কিছু কার্যকরী কমিটির সদস্য যাদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে। Shipp, প্রতিষ্ঠা সদস্য Stephens Whale, এবং তিনজন নতুন সদস্য William Archer, Rosita Forbes এবং Edward Shanks. মার্জরী ছিলেন এটারও সেক্রেটারি। ১৯২২ এর ফেব্রুয়ারীতে ইংলিশ পেনের আন্তর্জাতিক কমিটির প্রথম সভা বসল মিসেস স্যাফোর বাড়িতে। এই সময় ফরাসী কেন্দ্র মোটামুটি হয়ে গেছে আর বাইরের দেশের অন্য কেন্দ্রগুলি প্রস্তুতি নিচ্ছে।
১৯২৩ সালের পয়লা মে, লন্ডনের হোটেল সিসিল-এ আন্তর্জাতিক পেন- এর প্রথম সান্ধ্যভোজের আসর বসাল। আন্তর্জাতিক পেনের হেডকোয়ার্টার ইংলিশ পেন বাদে ১০টি দেশের ১১টি পেন কেন্দ্র যোগ দিল। বার্সিলোনা (স্পেন),মাদ্রিদ (স্পেন), বেলজিয়াম, চেকোশ্লাভিকিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রেন্স, ইতালী, নরওয়ে, রোমানিয়া, সুইডেন এবং আমেরিকা।তারা ১৬৪ জন অংশগ্রহন কারী প্রতিনিধি পাঠালেন। ইংল্যান্ডে আন্তর্জাতিক পেনের আদর্শগুলিকে মিসেস স্যাফো পরিমার্জনা করলেন। তিনি পেনের মা। তার অনুপ্রেরণায় পেন দেশে ও বাইরে বিস্তৃতি লাভ করতে লাগল। সাথী লেখকগন তাদের পারস্পরিক বোঝাবুঝির মধ্যদিয়ে পেনে যোগদান করতে লাগলেন।
অ্যামি ডসন স্কট যেদিন বললেন ‘ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে’,১৯২১ সালে, তার আজ ৯০ বছর। তার সুদুর প্রসারী স্বপ্ন, লেখকদের আন্তর্জাতিক সমাবেশ ও সম্পর্ক গড়া আজ বিশাল কর্ম কান্ডে পরিনত হয়েছে। দেশের প্রতি দেশের, জাতির প্রতি জাতির, বোঝাবুঝির, শান্তির একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে। এই আন্তর্জাতিক মঞ্চ আজ স্বীকৃত মানবাধিকার সংগঠন। আজ পৃথিবীর ১০৫টি দেশে ১৪৫টি কেন্দ্র।
মার্জরি ওয়াট বলেছেন, পেনের কেন্দ্রের মূল ছিলেন জন গলসওয়ার্দি। তিনি ছিলেন তখনকার দিনে অতিসুপরিচিত ও বিখ্যাত মানুষ।তার সাথে নানা দেশের যোগাযোগ ছিল। অ্যামি তাকে পরিচালক মন্ডলিতে যে করেই হোক আনতে পেরেছিলেন, পেনে যোগ দিয়ে তিনি দেশবিদেশের যোগাযোগই সাধন করেন নি। খুব তারাতারি তিনি পেন চলার গতিশক্তি রুপে আবির্ভূত হন।প্রচুর দেশভ্রমন করেন, তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিকে নিংড়ে দেশে বিদেশে অনেক সদস্য সংখ্যা বাড়ান। অ্যামি ও গলসওয়ার্দির মধ্যে অনেক চরিত্রগত ভিন্নতা ছিল।গলসওয়ার্দি একজন আইনজ্ঞ, সাবধানী, জ্ঞানী, আবেগে নড়েননা—এদিকে অ্যামি আবেগমথিত,উদ্দীপিত, অসাধারণ ও জেদী--- ওরা একে অপরের পরিপূরক। অ্যামির সাথে গলসওয়ার্দির মত পার্থক্য ছিল প্রচুর।তবু তাকে সম্মান করতেন, তিনি জানতেন গলসওয়ার্দির কথার যুক্তি থাকে এবং তাকে গলসওয়ার্দির কথা শুনে চলতেই হবে।
সাইমন বার্কার বলে একজনের কথায় জানা যায়, কি করে জন গলসওয়ার্দি পেনের সাথে জড়িয়ে পড়লেন।
তিনি প্রথম থেকেই পেনের সমর্থনে ছিলেন এবং এটা বুঝতে পেরেছিলেন তরুন লেখকদের তাদের ডেস্ক থেকে বেরিয়ে এসে জনসাধারনের বৃত্তে একে অপরের সাথে কথাবার্তা বলা দরকার। গলসওয়ার্দির উদ্দীপনার মূলে ছিল একটা ভাবনা। সে বিশ্বাস করে লেখক ও বুদ্ধিজীবিদের একটা সামাজিক দায়িত্ব আছে , অন্য লেখকদের প্রতি দায়িত্ব আছে। আছে দিনের শেষে সামাজিক বিষয় কেন্দ্র করে কথা বলা।
জন গলসওয়ার্দিকে যদিও আমরা চিনি ‘ফরসাইট সাগা’র জন্য কিন্তু তার জনপ্রিয়তার ব্যাপ্তি এত বিস্তৃত ছিল যে যখন তিনি তার কাজের জন্য আমেরিকায় নিউইয়র্কে গিয়েছিলেন, জাহাজের ডক থেকে তাকে লুকিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।কারণ তাকে দেখার জন্য এত লোকের ভিড় জমে ছিল—এটা বিটলসদের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন বিটলসরা প্রথমবার আমেরিকায় গেছিলেন তখন এমন হয়েছিল।
গলসওয়ার্দীর একটা সোস্যাল ইমেজ ছিল, তার নিজের বিয়ের জন্য লন্ডন ক্লাব থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন, তাই তিনি চাইছিলেন সামাজিক পটভুমিকায় তার সম্মানকে পুনরোদ্ধার করতে। আর লোকে ভাবছিল তার ব্যক্তিগত জীবনে কিছু ঠিকঠাক চলছেনা ।তখন তিনি নারীর অধিকার নিয়ে লড়তেন। যুদ্ধের সময় তিনি কারাগার সংশোধনের জন্য আইন সংস্কার করেন। অনেক কিছুই একা একা করেন। অনেক ভাল কিছু করতে চান অবশেষে দৃড়সংকল্পিত হয়ে লেখায় ফিরে আসেন। সাত্রে যেমন বলেছিলেন, “তরোয়াল ধরার অবস্থা থেকে বাঁচতে হলে আগেই কলম হাতে ধর”।
গলসওয়ার্দি কথাটার মানে পি.ই.এন. -এ নিয়েগেছিলেন।
পেন বা পি.ই.এন
পেন একটি বেসরকারী লেখকদের বিশ্বসংগঠন, বিশ্বের প্রথম মানবাধিকার সংগঠন, ইউনেস্কো বা ইউ.এন.ই.এস.সি.ও র বিশেষ পরামর্শদাতা, ইউনাইটেড নেশন এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপদেস্টা।
১৯২১ সালে এর শুরু হয়। উপলক্ষ ছিল যা তা হলঃ
১. লেখকদের মধ্যে বৌদ্ধিক সহযোগীতা ও পরস্পরের মধ্যে বোঝাবুঝি।To promote intellectual co-operation and understanding among writers;
২. লেখকদের একটা বিশ্বসংগঠন করা যেখানে বেড়ে উঠা পৃথিবী বা ক্রমউন্নতমান পৃথিবীর সংস্কৃতিতে সাহিত্যের মূল কাজ কি হবে তা স্থির করা এবং To create a world community of writers that would emphasize the central role of literature in the development of world culture; and,
৩. আধুনিক পৃথিবীতে দেখা যাচ্ছে লেখা ও লেখকদের অনেক হয়রানি জীবনের হুমকী, ভয়, বিপদ আসছে, তা থেকে লেখা ও লেখকগনকে বাঁচানো। To defend literature against the many threats to its survival which the modern world poses.
সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ
‘আন্তঃর্জাতিক পি. ই.এন.’ এই সংগঠনটি আজ থেকে ৯১ বছর আগে- ইউনাইটেড কিংডমের লন্ডনে - ১৯২১ সালে শুরু হয়। শুরুতে নামটি ছিল ‘পি. ই. এন’ বা পেন। শুরুর চার বছরের মধ্যে ইউরোপে ২৫টি কেন্দ্র স্থাপন হয়। এবং ১০ বছরের মধ্যে ১৯৩১ সালের মধ্যে দক্ষিণ আমেরিকা ও চীন সহ প্রচুর কেন্দ্র স্থাপন হয়। কেন্দ্রগুলি স্বাধীন ও স্বশাসিত।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে, (প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৪ – ১৮) পৃথিবীর প্রায় দেশগুলিতে সূচনীয় ও ঘনায়মান অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠছিল, তখন পি.ই.এন. এর সদস্য হয়েছিল অন্তর্ভুক্ত দেশবৃন্দঃ আর্জেন্টিনা,অস্ট্রেলিয়া, বলিভিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চিলি, কলম্বিয়া, মিশর, ভারত, ইরাক, জাপান, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, প্যালেস্টাইন, উরুগুয়ে, আমেরিকা এবং অন্যান্য। উত্তর ইউরোপের বা স্ক্যান্ডিনাভিয়ান দেশগুলি সহ পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ ও সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। বাস্ক, ক্যাটালান এবং ইদ্দিশ কেন্দ্রগুলিরও প্রতিনিধি ছিল।
আজ আট দশক পর, ব্যপক ও ভিন্ন ধরণের সংস্কৃতি, ভাষার সজ্জা ও বিস্তৃতি নিয়ে, ইউরোপের বাইরে ১৪৫টি কেন্দ্র নিয়ে ‘আন্তঃর্জাতিক পি.ই.এন’ গর্ব করার মতো একটি বিশ্বসংগঠন।
পি. ই. এন. হল বিশ্বে প্রথম বেসরকারী সংগঠন এবং যে কয়টি প্রথম আন্তঃর্জাতিক সংগঠন মানুষের অধিকার নিয়ে উকালতি করছে তার মধ্যে অন্যতম। নিশ্চিতভাবে, বিস্তৃত পৃথিবীর প্রথম লেখকদের সংগঠন ----এবং প্রথম সংগঠন যারা চিহ্নিত করেছিল একটি নীতি – বাক্স্বাধীনতা ও সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য বিষয়— একটি নীতি যা তারা উপরে ধরে রেখেছে আজও, তাদের চার্টারে বা সাংবিধানিক ধারায় স্থান দিয়েছে। ১৯২৬ সালে এই নীতির সূত্রপাত এবং ২২ বছর লেগেছিল তা নানা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে ১৯৪৮ সালের কোপেনহাগেন কংগ্রেসে চিরস্থায়ীভাবে গৃহীত হয়।
প্রায় কঠিন এক শতাব্দী ধরে প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের গড়ে উঠা ও প্রাদুর্ভাবে, -- তারপর ঠান্ডাযুদ্ধের মধ্যদিয়ে এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন এবং আজকের বিস্তারিত পৃথিবীর ভিন্নপ্রকৃতির ও সুক্ষ্ম ভিন্ন আবহাওয়ায় আন্তঃর্জাতিক পেন সাহিত্য ও স্বাধীনতাকে নিয়ে নানা টানাপোড়েনে চলেছে, দ্বন্ধ, পরীক্ষা, নানা আপত্তি অগ্রাহ্য ইত্যাদি করে সামলে আসছে। আজকের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় মোড়গুলির প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এবং এর নেতৃত্ববর্গ- প্রত্যেকযুগের সেরা ব্যক্তিগণ, বিখ্যাত ও বুদ্ধিজীবিগণ সহ, সকল অক্লান্ত ও উৎসর্গিত সদস্যবৃন্দেরা - লেখা, পড়া ও প্রকাশ করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়ার লক্ষ্যে সংগ্রাম করে চলছেন বিশ্বসংস্কৃতির কেন্দ্রগুলিতে।
পেন বা পি.ই.এন শব্দটা এসেছে ইংরাজী শব্দ পোয়েটস (কবি),এসেয়িস্টস (প্রাবন্ধিক),নভেলিস্টস (উপন্যাসিক) (পরে যোগ করা হয়েছে প্লেরাইটস ( নাট্যকার) ও এডিটরস (সম্পাদক দের) মূলতঃ মসীজীবি বা লেখক—কবি, নাট্যকার, সম্পাদক, প্রাবন্ধিক ও উপন্যাসিকগণের সমাবেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সদস্য সংখ্যা বেড়ে উঠার জন্য পি.ই.এন. আন্তঃর্জাতিক পেন বা পি.ই.এন নামে খ্যাতি লাভ করে।
প্রথমে ছিল একটা নতুন ধরণের ডিনার (সান্ধ্যভোজের) ক্লাব।
ক্যাথরিন অ্যামি ডসন স্কট, একজন ব্রিটিশ কবি, নাট্যকার এবং শান্তিবাদ কর্মী মহিলা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তান্ডবের পর সকল লেখকদের একত্রিত করতে চেয়েছিলেন। প্রথমদিকে এটা একটা সান্ধ্যভোজের আসর ছাড়া কিছুই ছিলনা, শুধু ছিল একটু জায়গা যেখানে লেখকরা সামাজিকতা বা নিজেদের মধ্যে ভাবনা-চিন্তার বিনিময় করতেন। পেন ক্লাব ইউরোপের অন্যান্য রাজ্যে স্থাপন হবে এবং লেখকরা সেখানে গিয়ে নতুন বন্ধুদের সাথে ভাবনা বিনিময় করবেন এইরকম ভাবনা চিন্তা ছিল। ডসন স্কটের সান্ধ্যভোজের অতিথিবর্গের মধ্যে একজন ছিলেন জন গলসওয়ার্দি, যিনি পেন এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হন,যিনি একটা আন্তঃর্জাতিক আন্দোলনের সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন---- যা নরনারী লেখকগনের জন্য বহু রাজ্যের জাতিগনের একটি ঐক্য সমাবেশ মঞ্চ।
রাজনীতির প্রশ্নে
পেন তার প্রথম কংগ্রেস উপস্থাপনা করে ১৯২৩ সালে, ১১ টি কেন্দ্র তাতে যোগ দেয়। ১৯২০ সালের থেকেই পেন তার চরিত্রে অদ্বিতীয়, সংস্কৃতি, ভাষা বা রাজনৈতিক দ্বিমত তোয়াক্কা না করে সকল লেখকগনদের একজায়গায় আনতে পেরেছিল।পেন অরাজনৈতিক সংগঠন কিন্তু এইসময়টাতে রাজনৈতিক পারদ চাপানউতর সবাই লক্ষ্য করছিল। বস্তুত, একটি প্রতিষ্ঠাকালীন নীতি—কোন অবস্থাতেই কোন রাজনীতি পেন ক্লাবে চলবেনা, এরকম ছিল। এতেই কাজ হয়েছিল, পেনে সবাই বাক্স্বাধীনতা, শান্তি ও বন্ধুত্ব বজায় রেখেছিল কিন্তু কোন রাজনৈতিক বিতর্ক ছিলনা।
১৯৩৩ সালে, যাইহোক, এই ভাবনাটাকে পরীক্ষায় এনে ফেলেছিল কারণ জার্মানীতে জাতীয় সমাজবাদীর ছায়া ফেলেছিল। ডুব্রবনিকে পেন কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা ঐ বছর বুঝেছিল রাস্ট্রিয় দমন ও অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ উপেক্ষা করে চলা কঠিন।
এমনকি ১৯২৬ সালে, বার্লিনে পেন কংগ্রেসে জার্মান পেন ও পেনের সাধারন সভ্যদের মধ্যে ভাবনার সংঘাত ও দুঃচিন্তার পারদ চড়ছিল। অনেক তরুন জার্মান লেখক- বার্টোল্ট ব্রেখট, আলফ্রেড ডব্লিন এবং রবার্ট মিউসিল তাদের অন্যতম ছিলেন---তারা বলছিলেন জার্মান পেন তাদের দেশে সত্যিকারের জার্মান সাহিত্য প্রতিনিধিত্ব করছেনা। তারা প্রেসিডেন্ট গলস ওয়ার্দির সাথে দেখা করেন তাদের হতাশার কথা জানালেন। নাট্যকার আরনেস্ট টলার বললেন রাজনীতি উপেক্ষা করে চলবেনা, রাজনীতি পেনে থাকবে---এটা সর্বত্র এবং এর প্রভাব থাকবেই।
বই পোড়ানো, পোড়ানোর আক্রোশ
১৯৩২ সালের বুদাপেস্ট কংগ্রেসে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির জন্য একটা আবেদন পাঠানো হয়েছিল সকল দেশের সরকারের কাছে। গলস ওয়ার্দী তখন পাঁচটি বক্তব্য ঘোষণা করেছিলেন- এটা ছিল পেন বিকাশের আরেক ধাপ যেটা আজ আমরা পেন চার্টারে দেখতে পাই।
তার পরের বছর রাজনৈতিক টানাপোড়েন অভুতপূর্বভাবে বেড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ উপন্যাসিক এইচ জি ওয়েলস ১৯৩৩ সালে গলস ওয়ার্দির মৃত্যুর পর পেনের প্রেসিডেন্ট হন। জার্মানীর নাজীরা তখন বই পোড়ানো উৎসবে মত্ত, ওয়েলস এর বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালান। জার্মান পেন প্রতিবাদ করতে পারলনা, ব্যর্থ হল। অধিকন্তু, টলারকে (তিনি এক ইহুদী ছিলেন) ডুব্রভনিকের কংগ্রেসে বলা থেকে বিরত করার চেস্টা করল। তারপরেই পেন থেকে জার্মান পেনের সদস্য পদ থেকে খারিজ করে দিল। বিবৃতিতে পেন বলল যদি জার্মান পেন তাদের জাতীয়তাবাদী আদর্শে চলে তবে তাদের পেন সংগঠন কে বাতিল করা হল।
জেল বন্দি লেখকদের দুটো পুরানো ঘটনাঃ
১৯৩০ সালের শেষের দিকে লেখকগনের পক্ষে সক্রিয়ভাবে আবেদন করা বা প্রতিবাদ করা পেনের অন্যতম কাজ হয়ে উঠেছিল। হাঙ্গেরীতে জন্ম আর্থার কোয়েস্টলার, তখন তিনি সাঙবাদিক ছিলেন, তিনি ফ্যাসিস্ট স্পেনে বন্দী ছিলেন, তাকে মৃত্যু দন্ড দেওয়া হয়েছিল। পেন তার মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হলে তিনি মুক্তি পান।
স্পেনের মহান কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা অন্যদিকে তার অ্যারেস্ট হওয়ার পরই তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তাকে বাঁচানো যায়নি। কারন পেন টেলিগ্রাম যখন পেয়েছে তখন দেরী হয়ে গেছে। ১৯৩৭ সালে প্যারিসে পেন কংগ্রেসে লোরকার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
যুদ্ধোত্তর পেনের দিনঃ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পেন পুরো অন্যরকম হয়ে গেল। আগে এর সৃস্টির পেছনে ভাবনা ছিল ক্লাব হিসাবে জাতি, ধর্ম ও বিশ্বাস যাইহোকনা কেন লেখকদের স্বাগতম জানানো। যুদ্ধের সময় লন্ডনে ও নিউইয়র্কে নির্বাসিত লেখকদের নিয়ে নতুন দল প্রতিষ্ঠিত হল। পেনে কিছু চাপও সৃস্টি হচ্ছিল যেমন যারা জার্মানে জাতীয় সমাজতন্ত্র সমর্থন করছিল বা অন্যত্র যারা এসব করছিল তাদের সাথে পেন কিভাবে ব্যবস্থা নেবে। এবং ক্রমশ বেড়ে উঠা আন্তঃর্জাতিক পেন সমাজ নিয়মিতভাবে কিভাবে যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে বা দরকারের সময় তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ রাখবে, এই প্রয়োজন থেকেই আন্তর্জাতিক পেনে ইগজিকিউটিভ কমিটি গঠিত হয়।
১৯৪৯ সালে আমেরিকান পেনের সংকল্পিত ভাবনায় পেন বিশ্বের লেখকদের প্রতিনিধি হিসাবে ‘ইউনাইটেড নেশনে’ পরামর্শদাতার মর্যাদা পায়। এবং ইউনাইটেড নেশনের শরিক।
১৯৫০ সালে পেন সদস্যগন যেসব লেখকদের লেখা বা মতামতের জন্য মৃত্যুদণ্ড বা জেল দণ্ড পেয়েছেন তাদের মামলাগুলি পরীক্ষানীরিক্ষার জন্য একটি কমিটি করার প্রয়োজন ভাবেন। তার ফল হিসেবে একটি কমিটি ‘রাইটার্স ইন প্রিজন’ গঠিত হয় ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে। আস্তে আস্তে পেন আন্তঃর্জাতিক মহলে প্রভাব বিস্তার শুরু করল।
ওলে শয়িঙ্কা এবং মেরিলিন মনরোর স্বামীর চিঠিঃ
১৯৬৭ সালে আমেরিকার নাট্যকার আর্থার মিলারের প্রেসিডেন্সীশিপের সময় পেন নাইজিরিয়ার কাছে একটা আবেদন রেখেছিল এমন একজন নাট্যকারের পক্ষে যিনি তখন তার দেশের বাইরে পরিচিতি পাননি। ওলে শয়িঙ্কাকে তার দেশের সর্বোচ্চ কর্তা জেনারেল ইয়াকুবু গোওন তাড়াতাড়ি মেরে ফেলার জন্য চিহ্নিত করেছিল। তখন বাইয়াফ্রান পৃথক হওয়া নিয়ে সেখানে গৃহযুদ্ধ চলছিল।
এক ব্যবসায়ী পেনের থেকে একটি চিঠি গোঅন এর কাছে নিয়ে গেছিলেন,শয়িংকার মুক্তির দাবিতে এবং বললেন কে চিঠিটা লিখেছে্ন, বস্তুত যিনি মেরিলিন মনরোকে বিয়ে করেছিলেন ( ১৯৫৬ সালে আর্থার মিলার মেরিলিন মনরোকে বিয়ে করেছিলেন) গোঅন যখন নিশ্চিত হন সে একই ব্যক্তি মনরোর স্বামী ও পত্রলেখক শয়িঙ্কার মুক্তি চাইছেন তখন গোঅন তার বন্দীকে মুক্ত করে দেন। শয়িঙ্কা তারপর দেশ ছেড়ে যান, অবশ্যই, পৃথিবীর বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার হিসাবে ১৯৮৬ সালে সাহিত্যের জন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পান।
রাশিয়ানরা নারাজ
মিলার রাশিয়ার লেখকদের সাথে দেখা করতে রাশিয়ায় যান, এবং মিলারকে বলা হয় যে তারা পেনের সদস্য হতে চান কিন্তু প্রধান বাধা হল পেনের চার্টার। মিলার পরিষ্কার করে বললেন যে তিনি এখানে চার্টার অদল বদল করে তাদের উপযুক্ত করার জন্য আসেননি। তিনি এসেছেন দেখতে কিসে পেন পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। যাইহোক তিনি এটা নিশ্চিত করেন যে পুব-পশ্চিম বিভাজন খোলা রাখা আছে। কিন্তু রাশিয়ান পেন ১৯৮৮ এর আগে সৃস্টি হয়নি। তার পরের তিন দশক—২০০০ সাল অব্দি পেন পৃথিবীর কোনায় কোনায় পৌছে গেছে ও তার শুভ ছাপ রেখে গেছে। পেনের আওয়াজকে জাতীয় বা আন্তঃর্জাতীক স্তরে মূল্য দেওয়া হয় বা সম্মান জানানো হয়, কিছু বিষয়ে যেমন - বাক্স্বাধীনতায়, অনুবাদ সাহিত্যে, মহিলা লেখকগনের সমস্যায় এবং কি করে সকল লেখকদের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর দিয়ে একত্রে আনা যায় ইত্যাদি। সেন্সরশিপ, মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা, জেলবন্দী এবং খুন—এসবের বিরুদ্ধে পেন ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
রাশদি প্রসঙ্গ
১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল, লেখকগন , প্রশাসকগন বা আন্তঃর্জাতিক সংগঠনগুলি অবগত আছে যে পেন জেল বা মৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন লেখকদের হয়ে কাজ করছে। ১৯৮৯ সালে,বুকার পুরষ্কার বিজয়ী সালমান রাশদী তার বই স্যাটানিক ভার্সেস এর লেখার চেয়ে বেশী আন্তঃর্জাতিক দৃস্টি আকর্ষন করেছিলেন,কারণ, ইরাণের আয়াতোল্লা খোমেনির ধর্মীয় ফতোয়া লেখকের মৃত্যু জারী করেন , তাদের মতে ইসলামের অবমাননা করা হয়েছে সালমানের বইয়ে। সালমান বাধ্য হয়ে আড়ালে লুকিয়ে যান। এরপর রাশদীর দুর্দশা সাহিত্যের এক ইতিহাস হয়ে উঠে। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত লেখক হিসাবে তিনি এক প্রতীক হয়ে যান। পেন ফতোয়া তুলে নেবার অভিযান চালায় পৃথিবীর সর্বত্র এবং প্রকাশকদের বইটি বিক্রীর সমর্থন দেয়। রাশদী আজ অব্দি আন্তঃর্জাতিক পেনের সদস্য এবং আমেরিকান পেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট।
কেন সারো-উইয়াঃ
১৯৯৫ সালে,পেনের চোখ আবার নাইজিরিয়ার দিকে ঘুরে গেল। পেন ৯০ সাল থেকে একটা মামলা লক্ষ্য করছিল। উপন্যাসিক,নাট্যরুপকার ও মানবাধিকার কর্মী কেন সারো-উইয়া । নাইজার ব-দ্বীপের কাছে ওগোনি জাতির লোকদের হয়ে প্রচারভিযান চালাচ্ছিল কেন সারো-ঊইয়া, তার জন্য তাকে ১৯৯২ সালে প্রশাসন প্রথম গ্রেপ্তার করল।। ওগোনিরা বৃহত্তরভাবে স্বয়ং শাসন বা স্বায়ত্বশাসন চাইছিল, এবং কেন সারো-উইয়া বহুজাতিক পেট্রোলিয়াম সংস্থা রয়াল ডাচ শেল এর কাছে আবেদন রাখছিল যে তারা যেন তেল নিকাশ করতে গিয়ে ওগোনি ল্যান্ডের পরিবেশ যা ক্ষতি করেছে তার দায়িত্ব নেয়। তার কয়েক মাস পর তাকে ছেড়ে দেয়। ১৯৯৩ সালে আবার একমাসের জন্য একটি শান্তিপ্রিয় প্রতিবাদের জন্য গ্রেপ্তার করে, ঐ আন্দোলনটা নাইজিরিয়ান সিকিউরিটি ফোর্সেস ভয়াবহ ভাবে দমন করেছিল। ১৯৯৪ সালে ৪ জন ওগোনি সর্দার মারা গেল মিলিটান্ট ওগোনিদের হাতে। সারো উইয়াকে আগেরবার এই সর্দারদের সাথে সভায় বসতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। প্রশাসন আবার তাকে ওগোনি ডানপন্থীদের ১৪ জনের সাথে গ্রেপ্তার করল। তাকে খুনের অপরাধে অভিযুক্ত করা হল। ১৯৯৫ এর ১০ মার্চ, পেনের আন্তঃর্জাতিক প্রচার অভিযান চলা সত্ত্বেও কেন সারো-উইয়া কে মারা হল। তারপর আন্তঃর্জাতিক চিৎকার, চাপ আসতে লাগল নাইজিরিয়ার সরকারের উপর। ১৯৯৬ সালে শেল কোম্পানীর বিরুদ্ধে নাইজিরিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা রুজু করা হল কেন সারো-উইয়া হত্যা সহ। ২০০৯ সালে শেল কোম্পানী ১৫.৫ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরন দিতে রাজী হল।
২০০৬ সালের অক্টোবরে, অ্যানা পলিটস্কোভায়া, একজন উচ্চ স্তরের রাশিয়ান সাংবাদিক, স্বাধীন খবরের কাগজে ‘নোভায়া গ্যাজেটা’ কাজ করতেন। চেচনিয়ার যুদ্ধের উপর তিনি খবর লিখতেন। তাকে মৃত্যুর হুমকী দেওয়া হচ্ছিল। একদিন তাকে তার বাড়ীর (অ্যাপার্টমেন্টের) লিফটে খুন করা অবস্থায় পাওয়া গেল। পেন তারপর থেকে খুনীকে আদালতে তোলার সর্বচেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তার তিন মাস পর, ২০০৭ এর জানূয়ারীতে, আমেরিকান তুর্কী লেখক এবং খবরের কাগজের সম্পাদক হ্রান্ট দিঙ্ক কে ইস্তানবুলে মারাত্মক ভাবে গুলি করে মারল। ডিঙ্ক তূর্কী সংবিধানের ৩০১ ধারায় তার লেখায় তুর্কীজাতি্কে অপমান করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত ছিল। ডিঙ্ক তুর্কী সরকারকে ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ান গনহত্যাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ছুঁড়ে দিয়েছিল।
পেন দিঙ্ক এর পরিবারকে সাহায্য করেছিল এবং তার হত্যাকারীকে চিহ্নিত করার চাপ দিল। এক তরুন তূর্কী উগ্রজাতীয়তাবাদীকে ধরা হল ও ডিঙ্ক কে খুন করার অপরাধে কোর্ট মৃত্যুদন্ড দিল,অন্যান্য দের সাজা দিল।
এই হল আন্তঃর্জাতিক পেন। আজও ডসন স্কট ও গলস ওয়ার্দীর আওয়াজ শোনা যায়। লেখকরা শক্তিশালী হচ্ছে,তারূন্যতা পাচ্ছে, নির্ভীক হচ্ছে। সবই আন্তঃর্জাতিক পেনের অভয়ে।
পেনের কাজ সঠিক ভাবে পালনের জন্য চারটি কমিটি আছেঃ ১. শান্তির জন্য লেখকদের কমিটি ২.জেলবন্দী লেখকদের কমিটি ৩. নারী লেখকদের কমিটি ৪.অনুবাদ ও ভাষাগত অধিকারের কমিটি।
‘পেন ইন্টারনেশনাল’ নামে পেন একটি ম্যাগাজিন ষান্মাসিকভাবে প্রকাশ করে। তাতে পৃথিবীর সকল প্রান্ত থেকে সমকালীন মৌলিক লেখা সংগৃহীত হয়। উঠতি লেখকগন থেকে প্রতিষ্ঠিত লেখকরা লেখা পাঠান। এই ম্যাগাজিনটি ১৯৫০ সালে শুরু হয়, নাম ছিল ‘বুলেটিন অব সিলেক্টেড বুকস’, তাতে পৃথিবীর সাহিত্যের উপর আলো ফেলে সাহিত্য মতামত প্রকাশ হত।পরে তাতে যোগ হল প্রবন্ধ, ছোট গল্প ও কবিতা।বর্তমানে ম্যাগাজিনটির যে আদল তা ১৯৮২ সাল থেকে।
চার্টার
১.সাহিত্য, যদিও কোনো জাতির, বা যেকোন ভৌগোলিক স্থানে তার উৎপত্তি, তার কোনো সীমানা নেই, সে সর্বত্র অবাধ বিচরণ করবে। রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক কোনো সংঘাত তাকে স্পর্শ করবেনা।
২.যেকোনো অবস্থায়- বিশেষ করে যুদ্ধের সময়, জাতীয় বা রাজনৈতিক আবেগ শিল্পকর্ম, পাঠাগার, বা পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারের সূত্রে পাওয়া বস্তুতে কখনো যেন স্পর্শ না করে
৩.পেনের সদস্যগন তাদের ক্ষমতা বা প্রভাব যা আছে সবসময় ভিন্নজাতিগনের মধ্যে শ্রদ্ধা ও পরস্পরের বোঝাবুঝিতে ব্যবহার করবে, তারা শ্রেণি,বর্ণবৈষম্য বা জাতির প্রতি ঘৃণা বর্জন করার শপথ নেবে। এবং পৃথিবীতে শান্তিতে বসবাস করার জন্য মানবিক আদর্শ গুলি তুলে ধরবে।
৪.পেন জাতি ও বিভিন্ন জাতির মধ্যে ভাবনাকে ব্যঘাতহীনভাবে পৌছে দেওয়া বা চালনা করা সমর্থন করে। সদস্যগন মানুষের অভিব্যক্তি প্রকাশ দমনকে বা বিরুদ্ধাচরণকে বাধা দেওয়ার বা প্রতিবাদ করার শপথ নেয়, তারা তাদের দেশের মধ্যে বা সমাজের মধ্যে অভিব্যক্তি প্রকাশের সকল মাধ্যমের স্বাধীনতাকে নিরাপত্তা দেয়।
৫.পেন ঘোষনা করে স্বাধীন বক্তব্য বা মুক্ত প্রকাশ।শান্তির সময় কোনো বিধিনিষেধকরণ চলবেনা। পেন বিশ্বাস করে প্রচন্ড উন্নত সংগঠিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পৃথিবীতে সরকারের, প্রশাসনের, বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মুক্ত সমালোচনা আবশ্যিক প্রয়োজন। এবং স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছায় সংযত থাকাও তাই সদস্যগন শপথ নেয় কোনো রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থে কেউ যদি সত্যের অপলাপ করে, স্বেচ্ছায় ভুলতথ্য পরিবেশন করে, মিথ্যা বলে তার বিরোধিতা করা।
লেখা ঃ অ্যালবার্ট অশোক